ইসরায়েল: যুক্তরাষ্ট্রের বরপুত্র কেন?

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন।।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ‘রাজনৈতিক পিতৃত্ব’ নেই, যা এতটা আগলে রাখে, আঁকড়ে ধরে এবং রক্তের বিনিময়ে রক্ষা করে—যেমনটি যুক্তরাষ্ট্র করে ইসরায়েলের জন্য। প্রশ্নটা সহজ: কেন? ইসরায়েল এমন কী করেছে, যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার সকল আগ্রাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দখলদারি—সবকিছুর বৈধতা দিতে সদা প্রস্তুত?
১. ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পৌরাণিক বিশ্বাস
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রভাবশালী একটি অংশ হলো ‘ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান’, যারা বিশ্বাস করে ইসরায়েল রাষ্ট্র বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণির বাস্তবায়ন। তাদের মতে, ইসরায়েলের টিকে থাকা মানেই শেষ যুগের যুদ্ধ ‘আর্মাগেডন’ ও যীশুর পুনরাগমন সম্ভব হবে। এই ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এক অলিখিত ‘ধর্মরাষ্ট্রের’ মতো।
২. ইহুদি লবি ও মার্কিন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী লবিগুলোর একটি হলো AIPAC। মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েলের সমালোচনা করা মানে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। নির্বাচনী তহবিল, গণমাধ্যম, সিনেট কমিটি—সবখানেই ইহুদি লবি এক দৃশ্যমান অথচ অনুপম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে, ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্ত যখন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে, তখনও মার্কিন রাজনীতিবিদদের মুখে থাকে—“ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার”।
৩. মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধঘাঁটি—ইসরায়েল
ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের এক “স্থায়ী যুদ্ধজাহাজ” বলা হয়—যেটি কখনো ডুবে না। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি, তেলসম্পদ, ও আরব প্রতিরোধের বিরুদ্ধ সুর দমন করতে ইসরায়েল কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরোয়ার্ড বেস’। এই ‘সারোগেট রাষ্ট্র’-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আরববিশ্বে তার সাম্রাজ্যবাদী উপস্থিতি নিশ্চিত রাখে।
৪. অস্ত্র বাণিজ্য ও রক্তের বাজার
যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ইসরায়েলকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়। এই টাকা আবার ফিরে যায় Raytheon, Lockheed Martin, Boeing-এর মতো মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের পকেটে। এই কোম্পানিগুলো ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ করে বাস্তব যুদ্ধমাঠে পরীক্ষা করায়। ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সেই অস্ত্র বিক্রি হয় “Tested in Combat” ট্যাগলাইনে।
৫. জাতিসংঘে ভেটোর রাজনীতি
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আনা ৪৫টিরও বেশি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে—মানবতার পক্ষে নয়, বরং বর্বরতার পক্ষে দাঁড়িয়ে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীরবতা নয়, সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতাই প্রমাণ করে—ইসরায়েল শুধু বন্ধুই নয়, আদর্শগত উত্তরাধিকারী—বরপুত্র।
৬. গণমাধ্যমে সত্য হত্যা
সিএনএন, ফক্স নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট—এইসব মূলধারার মার্কিন গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের কান্না, ধ্বংস, কিংবা গণহত্যা অনুপস্থিত। বরং প্রচারিত হয় ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার। এই সংবাদপত্র ও টেলিভিশনগুলো কার্যত ইসরায়েলের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে, যেখানে সত্য মরে যায়, এবং প্রোপাগান্ডা বেঁচে থাকে।
৭. সাংস্কৃতিক ও আর্থিক ইহুদিকরণ
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইনজীবী সংগঠন এমনকি হলিউড—প্রায় সবখানেই ইহুদি মেধা, ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। এই বহুমাত্রিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও মানসিকতাকে এমনভাবে গঠন করেছে, যাতে ইসরায়েলকে শুধু ‘বন্ধু’ নয়, জেনেটিক আত্মীয় মনে হয়।
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের বরপুত্র—এটি আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নয়, বরং এক বাস্তব ঐতিহাসিক সত্য। বরপুত্র বলেই সে অপরাধ করেও শাস্তি পায় না, বরং জাতিসংঘের সভায় শাসকের আসনে বসে। বিশ্ব বিবেক আজ নির্বাক, মানবতা জিম্মি, আর ফিলিস্তিনের শিশুরা পিতৃহীন, মাতৃহীন—শুধু এই ‘পিতামাতার’ নিষ্ঠুরতার জন্য।
ইতিহাসের একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে:
“যে পিতা অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, ইতিহাসের আদালত একদিন তাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।”
আরো পড়ুন