ফিলিস্তিন: রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, জাতির অস্তিত্ব

 

মনোয়ার হোসেন রতন ।।

যেখানে প্রতিটি কান্না এক ন্যায় বিচারের দাবি, এবং প্রতিটি প্রতিরোধ একটি পতাকা ওড়ানোর স্বপ্ন।

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু জাতি রয়েছে, যাদের কণ্ঠ বহুদিন অবদমিত থেকেছে, যাদের অধিকার শুধুই কাগজে লেখা এক সম্ভাবনা হয়ে থেকেছে। ফিলিস্তিন নামটি আজ শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ড নয়, এটি এক প্রতীক—আত্মত্যাগ, প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতার প্রতীক

বহু দশক ধরে যুদ্ধ, নির্যাতন, অবরোধ আর অমানবিক পরিস্থিতির মাঝেও এই জাতিটি একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য লড়ে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনকে কতটি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে?

বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ১৪৪ থেকে ১৫১টি দেশ ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে অধিকাংশ এশিয়ান, আফ্রিকান এবং ল্যাটিন আমেরিকান দেশ, এমনকি পূর্ব ইউরোপের কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্রও।

বিশেষ করে ২০১২ সালে, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে “অবজারভার রাষ্ট্র” (Observer State) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যেখানে ১৩৮টি রাষ্ট্র পক্ষে ভোট দেয়। এই রায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে এক বৈধ অবস্থান এনে দেয়।

যেসব রাষ্ট্র এখনও স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের অবস্থান কেন এমন?

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখনো অনেক শক্তিশালী দেশ রয়েছে যারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এইসব দেশের স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রধান কারণ গুলো হলো :

  • দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নীতির প্রতি অনুগত থাকা
    তারা মনে করে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার বিরোধ শুধুমাত্র আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। একতরফাভাবে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।
  • ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
    বর্তমানে ফিলিস্তিনের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিভক্ত—গাজা শাসন করে হামাস, আর পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করে ফাতাহ নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন অথরিটি। ফলে একটি একক, কার্যকর রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবে এখনও অস্পষ্ট।
  • ইসরায়েলকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখা
    বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। তাই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে সেই সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে।
  • আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ ও লবি
    ইসরায়েলপন্থী লবিগুলোর প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণ অনেক দেশকে এখনও দ্বিধার মধ্যে রেখেছে
  • স্বীকৃতির গুরুত্ব কেবল কূটনৈতিক নয়, মানবিকও

একটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কেবল কূটনৈতিক বৈধতা নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্বের স্বীকৃতি। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি মানে—নিজস্ব পতাকা, নিজস্ব সীমান্ত, নিজস্ব নাগরিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনে সুরক্ষা।

বিশ্বের বহু দেশ এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে ফিলিস্তিনের ওপর চলমান দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, এবং স্বীকৃতির মাধ্যমে একটি বার্তা দিয়েছে—

“তোমরা একা নও।”

ইতিহাসের পটভূমিতে ফিলিস্তিনের দুর্দশা

১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ফিলিস্তিনিদের ভূমি থেকে বিতাড়ন, দমন ও বৈষম্যের সূচনা হয়। এরপর বিভিন্ন যুদ্ধ, দখল এবং অবরোধ ফিলিস্তিনকে করে তোলে একটি জ্বলন্ত মানবিক সংকটের নাম

আজও, গাজা উপত্যকা একটি “উন্মুক্ত কারাগারে” পরিণত হয়েছে
যেখানে ঘরবাড়ি ধ্বংস, পানি-বিদ্যুৎ সংকট, চিকিৎসার অভাব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অব্যাহত বিমান হামলার আতঙ্ক প্রতিদিনের বাস্তবতা।

আশার আলো: পরিবর্তন আসছে

২০২৪ ও ২০২৫ সালে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন একসঙ্গে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের কণ্ঠ ছিল স্পষ্ট:

“শুধু ফিলিস্তিন নয়, এটি শান্তি ও ন্যায়ের স্বীকৃতি।”

এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি বার্তা দেয়—দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর আজ ন্যায়কে স্বীকার করার সময় এসেছে।

বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান

বাংলাদেশ সবসময় ফিলিস্তিনের পাশে থেকেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা ফিলিস্তিনের অধিকারকে সমর্থন করে আসছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে তাঁর প্রথম ভাষণেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।

আজও বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়, কূটনৈতিক এবং মানবিক সহায়তার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বীকৃতি কি সব সমাধান এনে দেবে?

না, রাষ্ট্র স্বীকৃতি পেলেই সব সমস্যার অবসান হয় না। কিন্তু এটি একটি জাতিকে তার অস্তিত্ব, অধিকার ও সম্মান পুনরুদ্ধারের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এটি:

  • আন্তর্জাতিক ফোরামে কণ্ঠস্বর তুলে ধরার অধিকার দেয়
  • অপরাধের বিচার চাইবার সুযোগ সৃষ্টি করে
  • বিশ্বজনমতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুলে দেয়
  • একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি শুধু একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা

আজ যেসব রাষ্ট্র এই স্বীকৃতি দিচ্ছে, তারা শুধু একটি ভূখণ্ডকে নয়, একটি জাতিকে তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে।

এখন সময়—বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্র ও জনগণ একত্রে বলুক:

স্বাধীনতা প্রত্যেক জাতির জন্মগত অধিকার।
ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো মানে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো।

যখন একটি শিশুর কান্না রক্তে ভেজে যায়,

যখন একটি জাতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বন্দিত্বে জীবন কাটায়তখন বিশ্ব বিবেক যদি মৌন থাকে, তবে তা মানবতার পরাজয়।

আজ ফিলিস্তিন কাঁদে, তাই আমাদের বিবেক জাগ্রত থাকা চাই।

আমরা স্বপ্ন দেখি—একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী, যেখানে ফিলিস্তিনের ছেলেমেয়েরা স্বাধীন আকাশে পতাকা ওড়াবে, রক্ত নয়।

inside post
আরো পড়ুন