একজন সবুজ হৃদয়ের মানুষের গল্প

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। কুমিল্লা নগরীর প্রিয় মুখ। সাদামাটা জীবন যাপন করেন। বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবার মানবিক নেতৃত্বে আলোচিত নাম। চেষ্টা করেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। স্বচ্ছ পথে চলতে। শিক্ষা জীবন থেকে কর্মজীবন সর্বত্র অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধ্যমত দাঁড়িয়ে গেছেন। এতে বিভিন্ন সময় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন। তবে তিনি পথ থেকে সরে আসেননি। অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদ করেন, এতে তার নিন্দুকের সংখ্যাও অনেক। তবে তার শত্রুরাও তাকে ঘিরে অনিয়মের অভিযোগ তুলতে পারেননি। ব্যক্তি জীবনে ধার্মিক মোসলেহ উদ্দিন বিশ্বাস করেন পরকালীন জবাবদিহিতায়। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি পরিবেশ নিয়েও কাজ করছেন। এনিয়ে লেখালেখিও করেন। তার লেখায় ফুটে উঠে লালমাই পাহাড়,গোমতী নদী কিংবা সবুজের বনের জন্য দরদ।
১৯৫৬ সালের পহেলা জুলাই কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ঝিনাইয়া গ্রামে তার জন্ম। বাবা মো: জোনাব আলী মাস্টার কুমিল্লা পি.টি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন। মাতা জাহানারা বেগম গৃহিণী। দশ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। পিতার চাকরিসূত্রে তিনি বিভিন্ন উপজেলায় পড়া লেখা করেন। জীবনের প্রথম পাঁচ বছর কাটে সিলেটের জৈন্তাপুরে। পরবর্তীতে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার গোবিন্দপুর সরকারি জুনিয়র হাইস্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করেন। কুমিল্লা থেকে গিয়ে নামতেন হরেশপুর রেল স্টেশনে। তারপর গরুর গাড়িতে ধর্মপুর বাজার। সেখানের একটি দোতলা বাড়িতে তাদের পরিবার থাকতো। রাস্তা ভালো ছিলো না। স্কুলে যেতে কাদায় পড়ে যেতেন। বাসায় এসে কাপড় পাল্টে আবার স্কুলে যেতেন। ওই সময়ের শিক্ষকরা ছিলেন সত্যিকারের জ্ঞান তাপস। ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেন। পড়াতে স্যার ফি নেননি। ক্লাসের পরে খই দুধ খেতে খেতে তাদের পড়াতেন। কিছু খই তাদেরও দিতেন। ওই সময়টায় শিক্ষার ভিত্তিটা গড়ে উঠে। কুমিল্লা হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ১৯৮০ সনে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। সেই কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কসবা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মানিকছড়ি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লা আধুনিক সদর হাসপাতাল, বুডিচং থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কুমিল্লা মেডিকেল এসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুলে বিভিন্ন মেয়াদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের পর সেখানে লেকচারার নিযুক্ত হন। পাঁচ বছর লেকচারার পদে চাকরির পর পিজি হাসপাতালে ট্রান্সফিউশন মেডিসিনে স্নাতকোত্তর কোর্স করেন। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। মাঝখানে দেড় বৎসর খুলনা মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ২০০৯ এ তিনি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। যে প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। ২০১৭-১৮ সেশনে তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ২০১৫ তে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস থেকে এফআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন ।
তিনি কুমিল্লা অঞ্চলের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ১৯৮৪ সনে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, কুমিল্লা শাখাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০-২০০১ সেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। চিকিৎসা, শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন সংস্থাকে তিনি স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকেন। কুমিল্লা শহরের উত্তরাঞ্চলে কাপ্তানবাজারে তিনি একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লা ইস্টার্ণ মেডিকেল কলেজটি তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বল্পব্যায়ী সিডি প্যাথ এন্ড হাসপাতাল বাদুরতলা কুমিল্লাকে প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে কুমিল্লা অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৫ থেকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কুমিল্লা অঞ্চলের সভাপতি হিসেবে পরিবেশ সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন। ২০১২ সনে তিনি ব্লাড ট্রান্সফিউশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি নির্বাচিত হন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান এসোসিয়েশন অব ট্রান্সফিউশন মেডিসিন সম্মেলনের একজন সফল সংগঠক। তিনি শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের ৬ষ্ঠ ব্যাচ এলামনাই এসোসিয়েশনের সভাপতি। কুমিল্লার বিনয় সাহিত্য সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ডা: রোকসানা বেগম ঢাকা ডেন্টাল। কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম মহিলা ডেন্টাল সার্জন হিসেবে কুমিল্লা শহরে প্র্যাকটিস শুরু করেন। শিশু স্বাস্থ্যের টুকিটাকি, আঞ্চলিক পরিবেশ আন্দোলন ও করোনা যুদ্ধ নামের তিনটি বই তিনি লিখেছেন। ইস্টার্ণ মেডিকেল কলেজ জার্নালের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও এডিটর ইন চিফ। তিনি ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও কানাডায় বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ। করে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সৌদি-আরব, আরব-আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ইরান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ায় ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে তিনি সিডি প্যাথ এন্ড হসপিটাল প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং ইস্টার্ণ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রধান উপদেষ্টা।
বরিশাল মেডিকেল কলেজে ভিপি থাকাকালীন স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ জানান,এমপি শাহজাহান ওমর বীর উত্তম তখন এমপি। তিনি মেডিকেল কলেজে গেলে তাকে বলি আপনার বোন যে হলে থাকে সেটা দেখে যান। গিয়ে দেখেন তার বোন কমন রুমে হাডবোর্ড দিয়ে তৈরি রুমে থাকেন। তিনি তা দেখে অভিমান করে বোনকে বলেন, এত কষ্ট করে থেকে ডাক্তারি পড়ার দরকার নেই, বাড়ি চলো। তিনি তাকে বুঝিয়ে বলেন, একটি ভবন নির্মিত হলে তারা সবাই আরামে থাকতে পারবেন। তারা একসাথে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এম এ মতিনের নিকট গিয়ে দাবি আদায় করেন। ওই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন ওয়ার্ড বয় ও নার্স রোগীদের জিম্মি করে টাকা নিতে দেখেন। তারা প্রতিবাদ জানান। এতে ওরা কর্মবিরতি করে। পরে নিজেরা পাঁচদিন ওয়ার্ড বয় নার্সের কাজ করেন। পরিচালক এসে অনিয়ম করা ১৬জনকে বদলি করায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বলেন,১৯৯১সালে শুনলাম কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হচ্ছে। অথচ ১৯৮১সালে কুমিল্লায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়ারউর রহমান ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বিষয়টি তখন তৎকালীন জেলা যুবদল সভাপতি শাহ মো. সেলিম ও ছাত্রদল সভাপতি আলাউদ্দিনকে জানাই। তারাসহ গিয়ে সংসদ সদস্য রাবেয়া চৌধুরীর নিকট যাই। তিনি বললেন ঢাকায় সরাসরি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিকট যেতে হবে। কিন্তু তার গাড়ি নেই। বিএডিসি সুপারেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার তারিক উদ্দিন মিয়াকে থেকে গাড়ি নিই। সেই গাড়িতে রাবেয়া চৌধুরী ঢাকায় যান।
কর্মজীবনে মানিকছড়ি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত অবস্থায় খুব আনন্দে সময় কেটেছে। মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে পেরেছেন। সেজন্য মানুষের মমতাও পেয়েছেন। সেখানের এক ভান্তে (ধর্মীয় গুরু) মালেরিয়ায় অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে তারা মন্ত্র পড়ে শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি নেন। তিনি বলার পর খাটিয়ায় কওে তাকে কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়। সেখানে চিকিৎসার তিনদিন পর তিনি উঠে বসেন। এটাকে তারা মিরাক্কেল মনে করে। অনেকে তাকে প্রণাম করতে আসে। তারা স্নেহ করে গাছের পাকা পেঁপে নিয়ে আসতেন। কিংবা ঘরের এক টুকরি চাল। ওই এলাকার রাজা ছিলেন কুমিল্লার মেজর গণির বন্ধু। তারও অনেক স্নেহ পেয়েছেন।
কর্মজীবনে আনন্দের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, অধ্যক্ষ হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে চারটি বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু করা।
৬৪বছরে জীবনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, জীবনের এই পর্যায়ে এসে তিনি তৃপ্ত। তিনি অনেক টাকার মালিক হতে না পারলেও মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছেন।
নতুন চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,তারা যেন আরো একাডেমিক হয়। পড়ার চর্চা চালিয়ে যায়। যেন মানবিক চিকিৎসক হয়। টাকার পেছনে যেন না ছুটে। আন্তরিক কাজ করলে টাকা তার পেছনে ছুটবে।
তার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে জানান, এই অঞ্চলের ক্যান্সার রোগীরা খুব অসহায়। তাদের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। তাদের জন্য কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। এদিকে শিশু হাসপাতাল করার জন্য সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরীসহ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে সেটি থমকে যায়। তবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সংকট দূর করা গেলে এখানে শিশুদের ভালো মানের চিকিৎসার দেয়া যাবে।