এক মহান মানুষের চলে যাওয়া

ডাঃ এ কে এম কামারুজ্জামান খানঃ

inside post

মানবিকতা, চিকিৎসা ও রাজনীতি

মনোয়ার হোসেন রতন ।।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও চিকিৎসা জগতে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা শুধু পেশাদারিত্ব দিয়ে নয়, মানবিক গুণাবলী, জনসেবার নিষ্ঠা ও সহানুভূতির গভীরতা দিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁদের মৃত্যু কেবল একটি জীবনপ্রদীপের নিভে যাওয়া নয়, বরং একটি যুগের অবসান। ডাঃ এ কে এম কামারুজ্জামান খান ছিলেন তেমনই একজন মানুষ – যিনি রাজনীতি, চিকিৎসা ও মানবিক মূল্যবোধের এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন।

একজন ব্যতিক্রমী মানুষ: পরিচয় ও পটভূমি

ডাঃ কামারুজ্জামান খান শুধু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লার তৎকালীন কুমিল্লা-১১ (বর্তমানে কুমিল্লা-১০, নাঙ্গলকোট উপজেলা) আসন থেকে পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তাঁর পরিচয় এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন একজন মননশীল চিকিৎসক, যিনি মনোচিকিৎসা ও সমাজসেবাকে একসঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন।

চিকিৎসার মাধ্যমে মানবসেবা

মনোরোগ চিকিৎসা এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে রোগীর দুঃখ-ব্যথা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। ডাঃ কামারুজ্জামান খান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে রোগীর মন বুঝতে পারতেন, শুনতেন তাঁদের কথা, এবং ভরসা জোগাতেন — যা একজন চিকিৎসকের সবচেয়ে বড় গুণ। তাঁর চিকিৎসা শুধু প্রেসক্রিপশনে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন একজন শ্রোতা, একজন সহচর এবং একজন নির্ভরতার প্রতীক।

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা যেখানে এখনও আমাদের সমাজে অপূর্ণতা ও কুসংস্কারে ঢেকে আছে, সেখানে তিনি এক ব্যতিক্রমী আলোকবর্তিকা। তিনি বারবার বলেছেন, “মানুষের মন বুঝে চিকিৎসা না করতে পারলে, শরীরের চিকিৎসা অর্থহীন হয়ে পড়ে।”

রাজনীতিতে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা

ডাঃ কামারুজ্জামান রাজনীতিতে এসেছিলেন জনসেবাকে বড় করে দেখার উদ্দেশ্যে। তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেননি, বরং একজন সচেতন সমাজকর্মীর ভূমিকায় কাজ করেছেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক সচেতনতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

তিনি রাজনীতিকে ক্ষমতার মাধ্যম নয়, জনসেবার মাধ্যম হিসেবে দেখতেন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ছিলেন মানবিকতা, যার ফলেই তিনি শুধু নেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন অভিভাবক। নাঙ্গলকোটের মানুষ আজও তাঁকে স্মরণ করেন একজন নির্ভরযোগ্য হাত হিসেবে, যিনি দরজা খুলে বসে থাকতেন অসহায় মানুষের কথা শোনার জন্য।

একটি অঞ্চলের নয়, একটি দেশের ক্ষতি

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে, ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে দুপুর ১২টার দিকে যখন ডাঃ কামারুজ্জামান খান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তা ছিল শুধু একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয় — তা ছিল নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা এবং দেশের সমস্ত মানবিক চেতনার এক অপূরণীয় ক্ষতি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৮৫ বছর।

তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি রোডের জামে মসজিদে। পারিবারিক কবরস্থানে, তাঁর প্রিয় জন্মস্থান নাঙ্গলকোট গ্রামে, তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে। শুধু রাজনৈতিক কর্মী নয়, অসংখ্য রোগী, সহকর্মী, ভক্ত ও সাধারণ মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন।

“আমরা হারিয়েছি একজন মানুষ, যিনি সবসময় অন্য মানুষের কথা ভাবতেন,” – এই মন্তব্যটি ছিল এক বৃদ্ধার, যিনি একসময় তাঁর রোগী ছিলেন।

যে শিক্ষা রেখে গেলেন

ডাঃ কামারুজ্জামানের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে একজন ব্যক্তি চিকিৎসা, রাজনীতি ও মানবিকতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে যেতে পারেন। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন—

  • মানুষকে সম্মান করতে হয় তাঁর দুর্বলতার সময়েও।
  • চিকিৎসা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি দায়িত্ব ও প্রতিজ্ঞা।
  • রাজনীতি মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করার একটি উপায় — যদি তা হৃদয় দিয়ে করা হয়।

তাঁর এই শিক্ষা আজ আরও বেশি প্রয়োজন, যখন দেশের রাজনীতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেকে দায়িত্বের থেকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন লাভের দিকে।

একটি আলোকবর্তিকা: আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা

ডাঃ কামারুজ্জামান খানের জীবন আগামী প্রজন্মের জন্য একটি “মডেল” — কীভাবে একজন মানুষ রাজনীতিক, চিকিৎসক ও মানবিক নেতা একসঙ্গে হতে পারেন। আজকের যুবসমাজ যদি তাঁর পথ অনুসরণ করে, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আরও মানবিক, আরও নৈতিক, আরও সচেতন একটি দেশ হয়ে উঠবে।

নাঙ্গলকোটের স্কুল-কলেজগুলোতে তাঁর নামে বৃত্তি, পাঠাগার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু হোক — এটি হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা। তাঁর লেখা, বক্তৃতা, চিকিৎসা-অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ করা দরকার — যেন আগামী প্রজন্ম তাঁকে জানে, তাঁর মত হতে শেখে।

শোক থেকে শক্তিতে রূপান্তর

আজ আমরা শোকাহত। তবে এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করাই হবে ডাঃ এ কে এম কামারুজ্জামান খানের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা। আমরা যদি তাঁর মতো সহানুভূতিশীল হতে পারি, তাঁর মতো নিরলসভাবে কাজ করতে পারি, এবং তাঁর মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি — তবে তাঁর মৃত্যু একটি শক্তিশালী উত্তরাধিকার হয়ে থাকবে।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আমরা তাঁকে হারিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, তাঁর আদর্শ, এবং তাঁর কাজ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে-

নাঙ্গলকোটের প্রতিটি ঘরে, দেশের প্রতিটি দায়িত্বশীল চিকিৎসক ও রাজনীতিকের চেতনায়।

আরো পড়ুন