ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরের পটভূমি
।। কাজী ফখরুল আলম।।
১৯৭৫ সনের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয় ইতিহাসের পাতায় তা সিপাহী জনতার বিপ্লব নামে অভিহিত। এই দিনে সিপাহী জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলো, যা বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো আর এর মাধ্যমে যে মহানায়কের পুনরায় আবির্ভাব ঘটেছিলো তিনি সেই জিয়া, যিনি ১৯৭১এর ২৫ মার্চ রাতেই তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “উই রিভোল্ট”। ৩ নভেম্বর থেকেই তিনি ছিলেন বন্দী। তবে তাঁর নামেই সিপাহী-জনতা বিপ্লব সংগঠিত করে তাঁকে মুক্ত করে দেশকে নৈরাজ্যের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব অর্পণ করে।
কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি ৭ নভেম্বরের কথা আসলেই ১৫ আগস্টের প্রসঙ্গ আসে। ৭ নভেম্বরের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জিয়া, সুতরাং ১৫আগস্ট জিয়ার ভূমিকা কি ছিলো?
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এসেই জিয়াকে তাঁর পিতার হত্যাকারী হিসাবে চিত্রিত করার একটা বয়ান তৈরি করেন। তার দলের লোকেরাও সে অনুযায়ী জিয়াকে শেখ মুজিবের খুনি হিসাবে চিত্রিত করার প্রয়াস চালিয়ে যায়।
পরবর্তীতে তারা ২০১০ সনে জিয়া প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলায় মেজর জেনারেল(অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরীর(৭৫এ লে. কর্নেল) সাক্ষাতকারকে নেতিবাচক ভাবে প্রচার করে। অথচ ওরা বুঝেইনা যে, ঐ সময় জিয়ার উক্তির মধ্যেই রয়েছে দেশপ্রেম এবং দেশের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য।
আমিন আহামদ চৌধুরী বিবিসিকে বলেন,” জেনারেল জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর জানানোর পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার, উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।”
চিন্তা করুন, তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। জিয়ার কথা শুনলে সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাহলে কি হাসিনা জিয়াকে খন্দকার মোশতাকের সাথে যুক্ত বলে প্রচারণা চালাতে পারতো ? আবার ৩ নভেম্বর যদি বন্দি করার পর জিয়াকে হত্যা করা হতো তখন তারা কি বলতো?
তৎকালীন সময়ে এদেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে জিয়ার আবির্ভাব ছিলো ধূমকেতুর মতো। তিনি আলোর দিশারী হয়ে পথ প্রদর্শন করেছেন জাতিকে ।
১৫ আগস্টের পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে নানামুখী দ্বন্দ্বে কখন কি হয় এরকম একটা অবস্থা ছিলো। একদিকে শেখ মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে থাকে, অন্যদিকে জাসদ তার গণবাহিনী নিয়ে পাল্টা অভুত্থান বা পাল্টা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে থাকে।
আবার সেনাবাহিনীর চীফ্ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন সিনিয়র কর্মকর্তারা ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভংগের অভিযোগ তুলে পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সেনাবাহিনীর ভেতরে এই সময়ে সুস্পষ্ট তিনটি ধারায় মেরুকরণ চলতে থাকে এবং আন্তঃকলহ প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। সেনাবাহিনীর শৃংখলা, পেশাদারিত্ব ও চেইন অব কমান্ড এক অর্থে কার্যকরী ছিলোনা। এই সময়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংগঠিত সেনা কর্মকর্তারা চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার কথা বলে নিজেরাই তা ভঙ্গ করে ৩ নভেম্বর সেনা প্রধান জিয়াকে গৃহবন্দি করেন। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের মাঝে তাদের এই অভ্যুত্থান কোনো প্রকার গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
একই সময়ে এই অভ্যুত্থানের স্বপক্ষে খালেদ মোশারফের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ এবং তার মায়ের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি মিছিল বের করে, যা ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। আর এই মিছিলটিই খালেদ মোশাররফের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
আবার আওয়ামী বাকশালী দুঃশাসন ফিরে আসছে চিন্তা করে দেশের জনগণ আতংকিত হয়ে যায়। এর মধ্যে প্রচার হয়ে যায় ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা এবং অসন্তোষ। আর এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে জাসদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিয়ে তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে সেনানিবাসে ভয়ংকর লিফলেট বিলি করে। তাদের লিফলেট এর শ্লোগান ছিলো- “সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই অফিসারদের রক্ত চাই। সুবেদারের উপর অফিসার নাই। ”
এই লিফলেটে খালেদ মোশাররফকে ভারতের চর বলে প্রচার করা হয়। এরই মধ্যে ৬ নভেম্বর রাতে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তথা গণবাহিনীর সদস্যরা সামরিক বাহিনীতে অফিসার বিরোধী শ্লোগান দিয়ে অফিসারদের গুলি করে হত্যা শুরু করে। তারা সামরিক বাহিনীর একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এ সময় হত্যা করা হয়।
এ রকম চরম বিশৃংখলার মধ্যে আতংকিত পেশাদার সেনা কর্মকর্তা, দলমত নির্বিশেষে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বন্দি সেনাপ্রধান জিয়ার জন্য ব্যাপক সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার ঘোষক, স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তিনি ছিলেন অসম্ভব সম্মানের অধিকারী ও জনপ্রিয়। আর তাই অধিকাংশ শক্তিই তার নামেই ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।
বন্দি জিয়াকে আবর্তিত করেই চারিদিকে শ্লোগান উঠতে থাকে ‘আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।’
জেনারেল জিয়ার প্রতি অনুগত ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সেনা-কর্মকর্তা ও জওয়ানরা লেঃ কর্নেল তাহেরের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা টের পেয়ে ৭ নভেম্বর রাতে জাসদের অভ্যুত্থান শুরুর ১ ঘন্টা আগেই ল্যান্সার মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে জিয়াকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করা হয়। নিরাপত্তার প্রয়োজনে তাকে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসে।
কর্নেল তাহেরের নির্দেশে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা জিয়াকে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাবার জন্য সেনানিবাসে এসে হতাশ হন। পরে কর্নেল তাহের জিয়াকে সেখান থেকে বের করে নেয়ার জন্য নিজেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে সম্পূর্ণ জিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় কর্নেল তাহের তার অনুগত সৈন্যদের খালেদ মোশাররফকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কর্নেল হুদার স্ত্রী নিলুফার হুদা তার লিখিত গ্রন্থ “কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ” বইতে স্পষ্টভাবে লিখে গেছেন কিভাবে কর্নেল তাহেরের নির্দেশে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা এবং মেজর হায়দারকে হত্যা করা হয়।
৭ নভেম্বর একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থান হয়েছিলো জাসদের মাধ্যমে, আর তারই সমান্তরালে আরেকটি রক্তপাতহীন সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো সিপাহী জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে। যার নেতৃত্ব এসেছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২য় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে। আর তাতেই মুক্ত জিয়া কিছুদিনের মধ্যেই কঠোর হস্তে সমস্ত বিশৃংখলার অবসান ঘটিয়ে দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেন।
লেখক:রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র।