কুমিল্লার শিক্ষার্থীরা জড়াচ্ছে অপরাধ ও ইন্টারনেট আসক্তিতে

রাশেদুল হাসান ফরহাদ।।
করোনায় গত আট মাস ধরে বন্ধ রয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে পড়ালেখা থেকে ছিটকে পড়ছে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ। আগের মত পড়ালেখার চাপ না থাকায় কুমিল্লা নগরীর অলি-গলিতে আড্ডা, ইভটিজিং, ইন্টারনেট আসক্তিসহ নানা অপরাধের সাথে জড়াচ্ছে তারা।
কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগরপাড়, টাউনহলসহ বিভন্ন এলাকাঘুরে দেখা গেছে, ১৫-২০ বছরের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনাগোনা। কেউ অনলাইন গেমস খেলছে, কেউ ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে পড়ে আছে, আবার কেউবা কোন ভাইয়ের কর্মী বনে অন্যজনের উপর প্রভাব খাটাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, ক্লাসে বসে পড়ার মত মজা ইন্টারনেট ক্লাসে পাওয়া যায় না, তাই সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ক্লাসে অংশগ্রহণ করি না। আবার অনেকে বলছেন ইন্টারনেটের ধীর গতি, বেশিক্ষণ ফোন ব্যবহার করলে মাথাব্যাথাসহ শারিরীক সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করি না।
সন্তানের পড়ালেখার এই হাল নিয়ে অভিভাবকরাও রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারা বলছেন, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়ায় তাদের পড়ালেখার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ার পর সেই চিন্তাটি একটু দূর হলেও এখন পড়ালেখার প্রতি তাদের অমনোযোগিতা আরো টেনশন বাড়াচ্ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, প্রথম প্রথম অনলাইন ক্লাসে বেশ উপস্থিতি থাকলেও এখন তা অত্যন্ত নগণ্য। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি প্রায় ৩০ ভাগের নিচে। তবে মেয়েদের উপস্থিতি বেশ ভালো। আমরা শতভাগ উপস্থিতির জন্য চেষ্টা করছি। তারা আরো বলেন, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎসহ নানা সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এছাড়া, ইন্টারনেটের ধীর গতির কারণে একই কথা বার বার বলতে হচ্ছে তাদের। এতে প্রথম প্রথম একটু ভালো লাগলেও এক অনেকটা বিরক্তি কাজ করছে। তাছাড়া অনলাইনে শিক্ষার্থীদের থেকে পড়া আদায় করা অনেক কষ্টের ব্যাপার। পড়া লেখার জন্য কাউকে একটু বকাবকি করইলেই ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ রসিকতা করে বলছেন, আগে মাইরা পড়া আদায় করণ গেছে না, এখনতো বাসায় বসে থাকে।
পুরাতন চৌধুরীপাড়া ইসলামী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরহাম জানান, ‘সত্যি বলতে অনলাইনে ক্লাস বিরক্ত লাগে। ইন্টারনেট সমস্যার কারণে স্যার বলে আমরা বুঝি না, আবার আমরা বললে আবার স্যার বুঝেন না। বেশিক্ষণ ইন্টারনের ব্যবহার করলেও মাথাব্যাথা করে তাই প্রথমে কদিন ক্লাস করলেও এখন আর করি না।’
বরুড়া শাহেরবানু স্কুলের শিক্ষক নয়ন দেওয়ানজি বলেন, ‘অনলাইনে ক্লাসে শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনেকটা পিছিয়ে আছেন। দারিদ্রতাসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই ফোন কিনতে পারছেন না। আবার ফোন থাকলেও ইন্টারনেটের ধীর গতির কারণে ক্লাস করা মুশকিল হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তবে আমরা চেষ্টা করছি। ফোন করে নিয়মিত শিক্ষাথীদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে অভিভাবকদের চাপে রাখছি’।
রাশেদুল হাসান চৌধুরী নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘লকডাউন শেষ হওয়ার পর এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে। তাহলে স্কুল কেন বন্ধ? অনলাইনে দীর্ঘ সময় ক্লাস করে বাচ্চার ফোনের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। স্বেচ্ছায় পড়বে এমন কোন আগ্রহও তাদের মধ্যে নেই। আগে বিদ্যালয়ের পড়া নিয়মিত আদায় করলেও এখন তা হচ্ছে না। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত উত্তরণ চাই।
এদিকে সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পার করছে অন্যরকম এক সময়। ভর্তির দিন কলেজে যাওয়া হলেও এরপর আর যাওয়া হয় নি। কিভাবে ক্লাস করবে বা কার কাছে গেলে ক্লাসের দেখা পাবে তারা জানেন না। সব মিলিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সময় পার করছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে পরিবার অনেকের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।
কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আছমা আক্তার জানান, ‘গত আগস্ট মাসে ভর্তি হয়েছি। এখনো পর্যন্ত কোন ক্লাস করতে পারি নি। কবে করতে পারবো তাও জানিনা। পড়ালেখার চাপ না থাকায় বইও কিনি নি’।
সনাক কুমিল্লার সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, ‘কথায় আছে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বন্ধু। লকডাউন শেষে দুটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এখন পর্যন্ত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলে নি। আর আমি একজন অভিভাবক হিসেবে নিজেও এসময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছি না। তবে অবসর সময়ে শিক্ষার্থীরা যাতে বিপথে না যায় সে বিষয়ে প্রথমে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে’। তিনি আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা যাতে কোন অপরাধের সাথে জড়াতে না পারে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো যেতে পারে।’
নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রোখসানা ফেরদৌস মজুমদার বলেন,‘ অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতে আমরা শতভাগ চেষ্টা করছি। উপস্থিতিও বেশ ভালো। তবে অভিভাবকরা অভিযোগ করছেন শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। ফেসবুক, ইউটিউভসহ নানান সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ ক্লাস আর অনলাইন মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষার্থীদের শতভাগ পড়ালেখায় ফেরাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিকল্প নেই।’