কুমিল্লায় পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি

 

পাসপোর্ট করার জন্য মেঘনা উপজেলা থেকে জেলা সদরে এসেছেন ছালাউদ্দিন আহমেদ। পেশায় রাজমিস্ত্রি। ছবি ব্যাংক ড্রাফট ও আইডিকার্ডের ফটোকপি নিয়ে গেলেন পাসপোর্ট অফিসে। তাকে জানানো হলো আবেদন ফর্মে প্রচুর ভুল। এভাবে অন্তত তিনবার সংশোধন করে আনলেন। তবুও ভুল রয়ে গেলো। ঘুরতে লাগলেন ছালা উদ্দিন। টানা তিন দিন ঘুরার পরে একজনের দেখা পেলেন। তাদের মধ্যে আলাপ আলোচনার হলো। সরকারি ফি’র বাইরে আরো আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। তিনি রাজি হলেন। পরে তার হাতে বাড়তি আড়াই হাজার টাকা দেয়ার পরেই আবেদন জমা হলো। আর কোন ভুলত্রুটি ধরা পড়েনি।

চৌদ্দগ্রাম থেকে এসেছেন আরিফ হোসেন। জরুরি পাসপোর্ট করবেন। জরুরি পাসপোর্টে সরকারি ফি লাগে ৬ হাজার ৯শ টাকা। পাবেন ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে। আরিফ খরচ করলেন ১৩ হাজার টাকা। এত বেশী টাকা কেন ও কাকে দিলেন। এমন প্রশ্নে আরিফ জানান, ভাই হেই বছর আর বড্ডা ভাই শরিফের লাই হাসফোর্র্ট রেনু কইত্তাম আইয়া দালালের কাছে যাই ন। হরে আঁর ভাইয়ের ভিসা ও¹ান বাতিল অই যায়। এইল্লাই এবার ভিসার লাই দালাল দইচ্ছি। হাসপোর্ট অপিসে আইয়া ঘুত্তাম ভালা লাগে না।

পাসপোর্ট অফিসের ভেতর থেকে ডাক আসবে। সে আশায় সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত বসে আছেন কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আরিফ হোসেন (ছদ্ম নাম)। কারো কাছে নাম বলা যাবে না, কোথাও ছাপা যাবে না এমন শর্তে আরিফ হোসেন জানান, ১০/১৫ দিন আগে একবার এক সাম্বাদিকের লগে কথা কইছি। এই কথা কওনের লাই¹া নাকি আমার অপরাধ অইছে। হেই দালাল আমার পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিছে না।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার কামাল্লা গ্রাম থেকে পাসপোর্ট করতে আসেন আলহাজ আবদুল মজিদ। তিনি জানান, আদেন ফর্মে রোড নম্বর কেন দেন নি বলে পাসপোর্ট অফিস থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তিনি যতই বলেন তার বাড়ি গ্রামে সেখানে রোড নম্বর নেই। কে শোনে কার কথা। তিনি আজ তিন দিন ধরে ঘুরছেন।
নগরীর রেইসকোর্স এলাকার মাহফুজ আলম শাকিল জানান, তার আবেদন ফর্মে দালালের কোন সিল নেই। তাই তিনি তার পাসপোর্ট আবেদনটি জমা দিতে পারছেন না। বোন ও ভাগিনা নিয়ে ঘুরছেন মোকাদ্দেস। দালালের কাছে না যাওয়ায় তার বোন ও ভাগ্নের পাসপোর্টটি হচ্ছে।

পুরো পাসপোর্টজুড়ে শুধু অভিযোগ। পাসপোর্ট অফিসের পাশের চা দোকানী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, অফিসের পিয়ন থেকে শুরু কতরে বড় স্যার পর্যন্ত সবার টেহা লাগে। ভাইরে কি কমুৃ পাসপোর্ট অফিসের মাডিও টেহা চায়। না দিলে ঘুরবেন। জুতা ক্ষয় অইবো। জুতা ছিড়বো – আর কিছু অইতো না। পাসপোর্ট অফিসের এমন দুর্ভোগের চিত্র প্রতিদিনের। এনিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক আমোদ একটি সংবাদ প্রকাশ করে।

সংবাদে উল্লেখ করা হয়, সরকারি নিয়মে ২১ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে খরচ হয় ৩ হাজার ৪৫০ টাকা, আর জরুরি প্রয়োজনে ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে খরচ হয় ৬ হাজার ৯শ টাকা। তবে সরকার নির্ধারিত ফিতে কেউ পাসপোর্ট করতে পেরেছেন এমন তথ্য পাওয়া যায় নি। ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা।

সেবা গ্রহীতাদের অনেকে বলেছেন দালাল ছাড়া যদি আবেদনটি জমা হয়েই যায় তবুও নিষ্কৃতি নেই। অফিসের ভেতরে সার্ভার নষ্ট, অফিসার আসেন নি, ছবিতে সমস্যা, জন্ম তারিখ ভুল এমন হাজারো সমস্যায় মাসের পর মাস আটকে থাকে পাসপোর্ট।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে তৈরি হয় পাসপোর্ট। বাইরে থেকে দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে পাসপোর্ট অফিস। দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে পড়তে হয় হয়রানিতে।
নগরীর ভেতর রেইসকোর্স (পুরাতন পাসপোর্ট অফিস), ঝাউতলা কান্দিরপাড়ে অন্তত ৩০ টি এবং পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে আরো অন্তত কুড়িটি দালাল চক্রের হাতেই জিম্মি পুরো পাসপোর্ট অফিস।
বছরে বিভিন্ন সময় র‌্যাবের অভিযানে দালালরা ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে এসে আবারো জড়িয়ে পড়েন দালালিতে।
দালাল ধরতে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব। র‌্যাব কুমিল্লা ১১ এর কোম্পানী অফিস সাকিব জানায়, গত এক বছরে নগরী ও পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়ে ৫৪২ টি পাসপোর্টসহ ৮ জন দালালকে আটক করা হয়। এ সময় দালালদের কাছ থেকে ভুয়া সিল সনদসহ পাসপোর্ট তৈরি বিভিন্ন অনুষঙ্গ উদ্ধার করা হয়। পরে নানান অভিযোগের পরে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলী করা হয়। তারপরেও বন্ধ নেই দালালদের দৌরাত্ম।

এদিকে ভোগান্তির শিকার মানুষদের অধিকাংশ কাজের জন্য বিদেশগামী। তাদের লেখাপড়া কম। এই মানুষদের শ্রমে ঘামে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। তাদের ভোগান্তি দূর করতে প্রশাসন দৃষ্টি দিবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।