কুমিল্লা ১ ও ২ আসন পুনর্বিন্যাস যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত


মোর্শেদুল ইসলাম শাজু।।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কুমিল্লা ১ ও ২ আসন দুটি পুনর্বিন্যাস করে সম্প্রতি খসড়া প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ দুটি আসন পুনর্বিন্যাস নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাম্প্রতিক খসড়া প্রকাশের পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে কুমিল্লার হোমনা, তিতাস ও মেঘনা উপজেলা। নতুন খসড়া অনুযায়ী, মেঘনা উপজেলাকে দাউদকান্দির সঙ্গে যুক্ত করে গঠন করা হচ্ছে কুমিল্লা-০১ এবং হোমনা ও তিতাস উপজেলাকে একত্রে নিয়ে গঠিত হচ্ছে কুমিল্লা-০২ সংসদীয় আসন। প্রস্তাবিত এ পরিবর্তনকে অনেকেই বলছেন “যৌক্তিক ও বাস্তবতানির্ভর সিদ্ধান্ত”।

হোমনা-তিতাস ঃ ভৌগলিকভাবে সুসংহত দুই উপজেলা –
হোমনা ও তিতাস উপজেলা চারপাশ থেকে স্পষ্ট ভৌগলিক সীমারেখায় ঘেরা স্বাভাবিক ও সরল সংযোগ। পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা এই দুই উপজেলার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাকা ও আধাপাকা সড়কে উপজেলা সদর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। নৌপথেও উভয় উপজেলা কিছুটা সংযুক্ত, তবে সড়কপথই প্রধান মাধ্যম।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, হোমনা উপজেলার জয়পুর, ভাষানিয়া, নিলখী ও মাথাভাঙা এবং তিতাস উপজেলর কলাকান্দি, বলরামপুর ও সাতানি ইউনিয়নের মধ্যকার ৭-৮টি গ্রামের সীমান্তঘেঁষা ইউনিয়নগুলো পারস্পরিক ও গভীরভাবে নির্ভরশীল। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ, এমনকি সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কেও এই দুই উপজেলার মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে নিবিড় সংযোগ। এছাড়া হোমনা উপজেলার মানুষ তিতাসের রাস্তা ধরেই জেলা শহর কুমিল্লা এবং রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যাতায়াত করেন।
সীমিত সংযোগ ও পার্থক্যে পৃথক মেঘনা-
হোমনা ও মেঘনা উপজেলার মধ্যে গড়ে উঠেছে একটিমাত্র বড় পাকা সেতু। এই সেতুটি হোমনা উপজেলার মাথাভাঙা ইউনিয়নের সঙ্গে মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়নকে সংযুক্ত করে। যা মূলত প্রশাসনিক কাজকর্ম ও সীমিত যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হলেও দুই উপজেলার মানুষের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ, যাতায়াত বা পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সীমিত।
মেঘনা উপজেলার ভাষা, কৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা কার্যক্রম মূলত দাউদকান্দি উপজেলার সঙ্গে আনেকটাই মিলে। নদীপথ ও সড়কপথে দাউদকান্দি হয়ে বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ, জেলা শহর কুমিল্লা ও ঢাকার সঙ্গে মেঘনার যোগাযোগ অনেক বেশি গতিশীল। এমনকি মেঘনার অধিকাংশ পরিবারের ব্যবসা-বাণিজ্য বা উচ্চশিক্ষার সংযোগও দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, সোনার গাঁও এবং ঢাকা কেন্দ্রিক।
জনসংখ্যা ও ভোটার বিন্যাস-
হোমনা উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার ৫৩৪, ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬১০, তিতাস উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩ হাজার ৯৫৩, ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৬৯, মেঘনা উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৬০, এবং ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ১১৬ এবং দাউদকান্দি উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ, ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫৩ হাজার ২৯৯।
এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মেঘনা ও দাউদকান্দিকে একত্র করলে প্রায় ৫ লাখ ২৫ হাজার ২১১ জনসংখ্যা এবং ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪৯টি ভোটার নিয়ে কুমিল্লা-০১ আসন একটি বৃহৎ ও কার্যকর নির্বাচনী এলাকা হিসেবে পরিগণিত হবে। অপরদিকে, কুমিল্লা-০২ আসনে হোমনা ও তিতাস একত্র করলে জনসংখ্যা ৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৮৭ এবং ৪ লাখ ৪ হাজার ৯৭৯টি ভোটার থাকবে।
নির্বাচন কমিশনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া গেজেটের ‘চ’ ধারায় বর্ণিত “জেলার মধ্যকার আসনের ভোটার সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ব্যবধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা” -ধারাটি বিশ্লেষণ করলেও জনসংখ্যা এবং ভোটার সংখ্যা নির্বাচন কমিশনের পুনর্বিন্যাস করা দুটি আসনের জন্যই মানানসই।
রাজনীতি ও প্রশাসন দুইয়ের সুবিধাই মিলবে –
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পুনর্বিন্যাসে শুধু সাংস্কৃতিক বা ভৌগলিক সংযোগই নয়, প্রশাসনিক কার্যকারিতাও অনেক বেড়ে যাবে। একজন সংসদ সদস্য যখন একটি সাংস্কৃতিকভাবে অভিন্ন ও পরস্পর সংযুক্ত অঞ্চলের দায়িত্ব পান, তখন উন্নয়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয়। এলাকা ভিত্তিক বরাদ্দ, সড়ক যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উন্নয়নও সহজতর হয়।
জনগণের প্রতিক্রিয়া-
দাউদকান্দি ও মেঘনা (কুমিল্লা-০১) এবং হোমনা ও তিতাস (কুমিল্লা-০২) আসনের খসড়া পুনর্বিন্যাসকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। এদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও স্থানীয় নাগরিকরা এই প্রস্তাবনার পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছেন।
শেষ কথা-
নির্বাচন কমিশনের খসড়া অনুযায়ী মেঘনা উপজেলাকে দাউদকান্দির সঙ্গে নিয়ে কুমিল্লা-০১ এবং হোমনা ও তিতাস উপজেলাকে একত্র করে কুমিল্লা-০২ গঠন একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। ভৌগলিক সংযোগ, জনসংখ্যার ভারসাম্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং প্রশাসনিক কার্যকারিতা সব দিক বিবেচনায় এই পুনর্বিন্যাস জনগণের কল্যাণেই কাজে আসবে বলেই অভিমত সচেতন মহলের।
লেখক: সভাপতি, হোমনা উপজেলা প্রেসক্লাব।