জুলাই জাগে বাংলাদেশ বাঁচে!

হুমায়ুন কবির।।
৩৬শে জুলাই ২০২৪। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য, উত্তাল দিন। ইতিহাসে তারিখটি থাকুক না ক্যালেন্ডারের বাইরে, তবুও গণমানুষের হৃদয়ে এটি খোদাই হয়ে গেছে। “জুলাই আন্দোলন”এই নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে সেই অগ্নিগর্ভ সময়, যখন হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বপ্ন দেখেছিল ন্যায়ের রাষ্ট্রের, সাম্যের সমাজের।২০২৫ সালের জুলাইয়ে এসে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আন্দোলনের এক বছর পর আমরা কি দেখতে পাই?
আমরা বাংলাদেশিরা ‘বাংলাদেশি’। না ‘বাঙ্গালী’। এটা এখন আমাদের মধ্যে প্রশ্ন? ‘বাঙ্গালী’ কলকাতায় ফ্লপ। কারণ তারা স্বাধীন হতে পারিনি। আমরা ‘বাংলাদেশীরা’ একটা ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র পেয়েছি। এটাই আমাদের বড় বিজয়। আমরা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারিনি।
১৯৭১ সালের আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। ‘পতাকা’ পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ্! আমরা ভাগ্যবান। ‘কলকাতা’ তা পারেনি। তার সাথে সাথে ‘সংবিধান’ আর ‘বিচারব্যবস্থা’ পেয়েছি। কিন্তু এখনও সেই আগের মত আমরা মারা যাই। বিচারহীনতায় আমরা মারা যাই। আর বিচারহীনতার দীর্ঘসুত্রিতা। আমরা মুক্ত হয়েছি ঠিকই কিন্তু পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে বের হতে পারিনি।
আমাদের পড়ালেখার উন্নতি করেছি ঠিকই। কিন্তু আমার ছোট ভাই ‘সুইডেনে’ পড়তে গেছে ‘ম্যাথম্যাটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং’ এ। পড়তে গেল অনেকগুলো টাকা খরচ করে। পড়তে গিয়ে যা বলল তা এরকম। ভাইয়া, ‘সুইডেনে এসে দেখি, যে সকল বই যেমনঃ ‘কর্টন’ এর ‘সফটওয়্যার’ আমাদের এখানে পড়ানো হয় ‘ম্যাথম্যাটিকস’ ডিপার্টমেন্টে ২০২২-২৩ সালে আর সেই ‘কর্টন’ সুইডেনে পড়ানো হয়েছে ১৯৭৮-৮০ সালে’। আমরা এসে এখানে না পারি কোর্স শেষ করতে। না পারি দেশে ফিরে যেতে। আমার ভাই পড়াশুনায় বরাবরই ভালো। আলহামদুলিল্লাহ! ছাত্র জীবনে কখনো দ্বিতীয় হওয়ার রেকর্ড নাই। এখনও খুব কষ্ট করে ‘ফাস্ট ফুড’ এর দোকানে চাকরি করে দিন গুজরান করছে।
‘পড়াশুনা’ যদি আধুনিক রুপে রুপ দেয়া না হয়। তাহলে সে সেখানেই থেকে যাবে। বরং সে সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে। তার অর্থ দাঁড়ায় সে ধীরে ধীরে আরও নিচে অবস্থান করবে। একটা ‘বাটন ফোন’ দিয়ে যেমন ‘স্মার্ট ফোন’ ব্যবহারের সুবিধা পাওয়া যায় না। তেমন একটা ‘স্মার্ট ফোন’ এর আপডেটেড ভার্সন (আধুনিক রুপ নেয়া সংস্করণ) ‘অ্যানড্রোয়েড ভার্সন’ ব্যবহারের সুবিধা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ ‘অ্যানড্রোয়েড ভার্সন’ হলেই হবে না তার ‘আধুনিক রুপ নেয়া সংস্করণ’ লাগবে। সে জানুক চাই বা না জানুক। এটা যুগের চাহিদা বা সময়ের আবদার। ১৯৭৮-৮০ সালের পড়াশুনা দিয়ে ২০২২-২৩ সালের পৃথিবীকে বুঝতে হলে ওই ‘ফাস্ট ফুড’ দোকানের সহকারী হিসেবে দিন গুজরান করা যাবে কিন্তু পৃথিবী পরিবর্তনে কোন অবদান রাখা যাবে না।

আমার ডান হাত কাজ করে না। সেখানে আমি বাম হাতে লিখতে চেষ্টা করে সফল হই। এক পৃষ্ঠা লিখতেই দিনপার হয়ে যাবে। সেখানে ‘আধুনিক ল্যাপটপের’ কল্যাণে এখন সবই সম্ভব হচ্ছে। আমার প্রতিবন্ধী জীবনে আশার আলো দিয়েছে এই ‘আধুনিক ল্যাপটপ’। আমি মানি, আর না মানি। আমি জানি, আর না জানি। তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না। আমি অভিযোজিত হতে পারি, আর না পারি। যেমন ল্যাপটপের কিছু যায় আসে না। আবার আমরা সাবমেরিন ক্যাবল বা আন্তঃসাগরীয় তারের সংযোগ যা আমাদেরকে ফ্রি দিচ্ছিল। সেই সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ এনেছি পরে অনেক টাকা খরচ করে। এটা হয়েছে শুধু সিদ্ধান্তহীনতায় বা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত আর এটা বুঝতেই বিচক্ষণ নেতৃত্ব লাগে। আমাদের সঠিক নেতৃত্ব লাগে। আর এই জন্যেই পড়াশুনার ভিত্তিটাকে অনেক বেশী শক্তিশালী আর অনেক বেশি যুগোপযোগী করার সময়ের দাবি। আমরা মানি, আর না মানি। এটাই সত্যি। এক ‘মাহাথির মোহাম্মাদ’, পড়ালেখাতে শুধু ‘বিজ্ঞান’ আর ‘প্রযুক্তিকেই’ এগিয়ে নিয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে আজ ‘মালয়েশিয়া’ উন্নতির চরম শিখরে পৌছে গেছে।
আমরা শুধু ‘ভয়’ আর ‘অনিশ্চয়তা’ আমাদেরকে পিছনে ফেলে দেয়। কোন কিছুর প্রতিবাদ করিনা। মনে করি ‘প্রতিবাদ’ করলে বুঝি আমার ‘পদ’ চলে যায় বা ‘অমক সুবিধা’ যদি আর না পাই। ‘অনিশ্চয়তা’ মনের ভিতরে ভর করে বার বার। আচ্ছা,ধরি আর যারা ‘নিশ্চিত’ সবকিছুতে। তারা কি তাদের ‘পদ’ আর ‘সুবিধা’ চিরকাল ধরে রাখতে পারবে? পারবে না। সত্যিই পারবে না। কারণ এটাই বাস্তব। তবে কেন তাদের মধ্যে এমন ‘দ্বিচারিতা’? ডুপ্লিমেছি বা ‘দ্বিচারিতা’। পাছে লোকে কিছু বলে। এটাই আমাদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
‘নারায়ণগঞ্জ’ শহরের একটি দেশ। নাম তার “সিঙ্গাপুর”। এই দেশটি আমি ভিসিট করতে যাই। ২০০৯-২০১০ সালের দিকে। ছোট একটি দেশ। কিন্তু ওদের পারকেপিটা ইনকাম অর্থাৎ জিডিপি ইনকাম আমাদের থেকে অনেক গুণ বেশী। ‘সিঙ্গাপুর’ বাংলাদশের চেয়ে ২০৩গুন ছোট। তারা নিজেদেরকে কিভাবে উন্নতি করেছে। ওদের উন্নতির পিছনে একটি লাইনই যথেষ্ট। তা হলো-“সিঙ্গাপুর ইজ আ ফাইন সিটি, ওইথ ফুল অফ ফাইন”। বাঙ্গালীকে সোজা করার ব্যবস্থা হচ্ছে ‘জরিমানা’।
বাংলাদেশ আজ যেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে। দুই দিকে দুইটি পারমানবিক শক্তিধর দেশ। ‘পাকিস্তান’ আর ‘ভারত’। তার পাশে একটা অস্থির দেশ “ মিয়ানমার” আর বাংলাদেশের তিন দিকে “ভারত”। আর একদিকে খোলা ‘বঙ্গোপ সাগর’।আমাদেরকে অনেক বেশি সাবধানী হতে হবে আমাদের ‘পররাষ্ট্রনীতিতে’। আমাদের সামরিক বাহিনীকে আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু জুলাই আন্দোলন, ২০২৪ আমাদের সে বার্তা দেয়না। জুলাই আন্দোলন আমাদের ভয়-ডরহীন এক আশা-জাগানিয়া এক বার্তা দেয়। শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের শান্তিপূর্ণ দাবিতে, তবে ১৫ জুলাই পুলিশি জবরদস্তির পর পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিপ্লবের আগুন। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১,৫০ ০ জন প্রাণ হারায় জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী।
“ যা বাবা, ভালো থাকিস বলে কেমন করে বুক চিতিয়ে দিয়েছিল সামনা সামনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাইদ”।
“পানি লাগবে পানি”- এভাবেই পানি বিতরণ করলেন।‘মুগ্ধ’দের আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। এভাবেই মুগ্ধর মুগ্ধতা ছড়িয়ে জীবন দিয়ে গেল।
শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা বলেন,“অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি। যে দেশটাকে ছেলে ভালোবাসল, সেই দেশ তো নিরাপত্তা দিতে পারল না। আমার বুক তো খালি হয়ে গেল। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।’
‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ইন্ট্রোতে রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ ইংরেজিতে এ কথা লিখেছিলেন।
ফারহান ফাইয়াজ জুলাই আন্দোলনে ধানমন্ডিতে নিহত হয়েছেন। রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজের আত্মীয় নাজিয়া খান। ফারহানের সঙ্গে হাসিখুশি একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ। হি ইজ ডেড নাও। আই ওয়ান্ট জাস্টিস (এই আমার ফারহান আইয়াজ। সে এখন মৃত। আমি ন্যায়বিচার চাই)।’
“দেশের অবস্থা ভালো না, ছোট ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসি’,শয্যাশায়ী মা ঝরনা বেগমকে এ কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন চিকিৎসক সজীব সরকার। ‘আমার ডাক্তার ছেলেকে তারা গুলি করে মারবে কেন?’
বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী সায়ান এর কণ্ঠে গানটা শুনে, কার না চোখে জল আসে। গানটির শীর্ষক “আমি জুলাই এর গল্প বলব বন্ধু”- এমনি তার দরদ ভরা গানটি… “জুলাই ভিজেছে আমার মেয়ের রক্তে। শ্লোগান দিয়েই নাঈমা মরেছে ঘরে। স্বর্গের ছাদে খেলা করে রিয়া ঘোষ। ঐ যে নাফিজ রিকশা-পালকি চড়ে। নাফিজ যাচ্ছে রিকশা-পালকি চড়ে। “একটাই মরে বাকিডি যায় না স্যার”ৃ লাশের পাহাড় রাখা ছিল উঁচু করে ক্ষমা করবো না বিশ্বাসঘাতকতা। সব জেনে যারা জুলাই বিক্রি করে।
আমরা জুলাই বিক্রি করি না বন্ধু। কেউ কি বলো তো নিজেকে বিক্রি করে। আমরা সবাই এখানে জুলাই বন্ধু। জুলাই রয়েছে এ মাটির অন্তরে। আমরা জুলাই ভুলতে দেবো না বন্ধু। আমরা জুলাই-এ আজো নেই নিঃশ্বাস বুকের ভেতরে আনাসের লেখা চিঠি রাস্তায় পড়েছিল ইয়ামিনের লাশ। আমরা জুলাই-এ ফিরে ফিরে যাই বন্ধু। তাছাড়া লড়াই কখনো হয় না শেষ। শত্রুরে বলি হবেই ধূলিসাৎ। এ মাটির নাম এখনো “বাংলাদেশ”। কেননা আমরা এখনো “বাংলাদেশ” ৃ কেননা এখনো মরেনি বাংলাদেশ”।।
লেখক: উদ্যোক্তা,টাট্কা এগ্রোফার্ম,মিথিলাপুর,বুড়িচং।