কেন দেয়ালচিত্রে আলোকচিত্রীর নাম থাকবেনা ?
।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট।।
কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র “সাপ্তাহিক আমোদ”-এর গত ১৬ মার্চ সংখ্যার একটা বাই-লাইন সংবাদ বা বিশেষ প্রতিবেদন আমায় হঠাৎই আকর্ষণ করলো । প্রথম পাতার ডান কোণে দু’কলাম ব্যাপী ছাপা হয়েছে রিপোর্টটি বা নিউজটা । ওপরে শোল্ডারের জায়গায় নিচে দেয়া হয়েছে শিরোনামের আন্ডারলাইন । এখন ডেস্কের দায়িত্বে যে বা যারাই থাকেন (সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, সহ-সম্পাদকসহ অন্যান্যরা) হরহামেশাই তা ব্যবহার করতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছেন । নিউজটার গুরুত্ব এবং তাৎক্ষণিকতার প্রসঙ্গ বিবেচনায় না নিয়েই । শুধুমাত্র অঙ্গসৌষ্ঠবের খাতিরে ।
সংবাদটার শিরোনাম ছিলো–“দেয়ালচিত্রে নেই আলোকচিত্রীর নাম” । আর শিরোনামের নিচের লাইনে ছিলো–“বঙ্গবন্ধুর কুমিল্লা পুলিশলাইনস পরিদর্শন” । আবু সুফিয়ান রাসেল নামে বাই-লাইনে লিখিত সংবাদটিতে কুমিল্লার ক’জন বিশিষ্টজনের অভিমতও ছাপা হয়েছে এ প্রসঙ্গে । এমনকি কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো: আব্দুল মান্নান মহোদয়ের বক্তব্যও সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু এই বিশেষ সংবাদটিতে আপার শোল্ডারে “বঙ্গবন্ধুর কুমিল্লা পুলিশলাইনস পরিদর্শন” না দিয়ে কেন লোয়ার লাইনে বা “দেয়ালচিত্রে নেই আলোকচিত্রীর নাম” শিরোনামের পর দেয়া হলো কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা । কেননা বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়-সদৃশ ব্যক্তিত্ব সারা বিশে^ বিরল । তারপরও বলছি বোধকরি, বার্তা সম্পাদক সাহেব সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন । কেননা, এই বিশেষ প্রতিবেদনে জাতির জনকের চাইতে তাঁর আলোকচিত্রটি সবিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে । এর কারণে চিত্রগ্রাহককেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই ।
প্রথমে এই বিশেষ রিপোর্টটি (সংবাদ) পড়ে বিস্মিত হয়েছি, আঘাত পেয়েছি এবং শেষে একটা সাধারণ সৌজন্যবোধের ব্যত্যয় অনুধাবন করেছি তা বলাই বাহুল্য । কেননা পুলিশ বাহিনীর মতো একটি অত্যন্ত নিয়ম-শৃংখলাবোধ সম্পন্ন এবং মানব-কল্যাণে গঠিত ডিসিপ্লিন্ড ফোর্স কি করে এত বড় একটা ভুল করলো । যে বাহিনী জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রথমেই সাড়া দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সেই একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত থেকেই এবং ২৬ মার্চের কাকভোরে প্রথম তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো । এ দেশের সর্বস্তরের আপামর জনগণের জান-মাল রক্ষার্থে । অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ।
কুমিল্লায়ও পুলিশবাহিনী পাকী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো ২৫ মার্চের কালরাতে । জন্মসূত্রে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জনপদ কুমিল্লার দশ নম্বর ওয়ার্ডের তালপুকুরপাড়ে বসবাস করি বলে ২৫ মার্চ সারারাত ধরে পুলিশলাইনে গোলাগুলির প্রচন্ড শব্দে আতঙ্কিত, ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়েছি । পরে জেনেছি, সে রাতে পুলিশলাইনে অবস্থানকারী পুলিশবাহিনীর অসংখ্য কর্মকর্তা এবং সদস্য প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন । দেশমাতৃকার বৃহত্তর স্বার্থে । বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ¦ানে সাড়া দিয়ে ।
সেই টাওয়ারীং পারসোনেলিটি বা আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় আসছেন জেনে আমরাও পাশর্^বর্তী এলাকা থেকে পুলিশলাইনের সীমান্তে ছুটে গিয়েছিলাম একনজর তাঁকে দেখবার জন্যে । চার জুলাই, ১৯৭২ সালে । কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে বা নিরাপত্তার ঘের টপকিয়ে সেখানে যাওয়া একরকম দু:সাধ্য কাজ বলে পুলিশলাইনের মোড়ে গন্ডির বাইরে বহু দূরে মূল সড়ক থেকে জাতিরজনককে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিলো । তখন সবেমাত্র জীবনের বাইশটা বসন্ত পার হয়েছে । তাই মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে এ দেশের অবিসংবাদিত নেতাকে দেখবার উদ্যম, আগ্রহ ও আকর্ষণ এবং ভালোবাসা স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকবে । পাশের আবাসিক এলাকা বাগিচাগাঁও ও তালপুকুরপাড় থেকে একদল যুবক বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে তাই জড়ো হই । অনেক দূর থেকে দেশের অন্যতম প্রাচীন যুগান্ত সৃষ্টিকারী সাপ্তাহিক আমোদ সম্পাদক প্রয়াত মোহাম্মদ ফজলে রাব¦ী এবং তাঁর সাংবাদিক ছেলে বাকীন রাব্বীকে বক্স ক্যামেরা নিয়ে বিরাট পুলিশলাইন মাঠে দেখতে পাই । বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী হেলিকপ্টার সেখানেই অবতরণ করেছিলো ।
এর অনেক বছর পরে অবশ্য কুমিল্লা থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সাংবাদিকতায় ভিড়েছি । দ্য ডেইলি নিউ নেশান পত্রিকার কুমিল্লা করেসপন্ডেন্ট হিসেবে । সেই ১৯৮১ সালে । তখন জেনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কুমিল্লায় সুভাগমনকে বরণীয় ও স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর সাপÍাহিকের পাতা জুড়ে শ্রদ্ধেয় রাব্বী সাহেব ও আমাদের সহকর্মী ও ছোটভাই বাকীন অনেকগুলো ছবি তুলেছিলেন। প্রথমে বাকীনের মতো ছোটখাট অবয়বের একজন ফটো-সাংবাদিককে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সদস্যরা সাংবাদিক পাশ থাকা সত্ত্বেও ঢুকতে দিতে চাইছিলেন না ।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ইশরায় কি যেন বললেন তাদের, তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীদের। তারপর, আমাদের সহকর্মী-ছোটভাই বাকীন বঙ্গবন্ধুর বেশকটা ছবি নিতে পেরেছিলো । আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু কুমিল্লার প্রথিতযশা সাংবাদিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী এবং তাঁর দীর্ঘদিনের শ্রমের ফসল ইতোমধ্যে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট জেলা এবং আশপাশ অঞ্চলের জনগণের কাছে সমাদৃত সাপ্তাহিক আমোদ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন । তাই বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার কর্মসূচি কভার করবার ও ছবি তোলার ব্যাপারে কোন অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি ।
সেই ছবিগুলোর মধ্য থেকে তাইতো, কুমিল্লা জেলা পুলিশের সৌর্য, বীর্জ, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগ সম্বলিত একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ “১৯৭১: কুমিল্লা পুলিশলাইন” যখন ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। তাতে ১০৬ পাতায় “বঙ্গবন্ধুর কুমিল্লা পুলিশলাইনসে প্যারেড পরিদর্শন” সংক্রান্ত একটা ছবি স্থান করে নেয় । ছবিটি তুলেছিলেন কুমিল্লার আপামর জনগণের শ্রদ্ধার আর ভালোবাসার ব্যক্তিত্ব আমোদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী । পরবর্তীতে এই ছবিটি “কুমিল্লা পুলিশলাইনে বঙ্গবন্ধুর প্যারেড পরিদর্শন” (৪ জুলাই, ১৯৭২) হিসেবে দেয়ালচিত্রে স্থান পায় । ম্যুরেল হিসেবে ।
কিন্তু অজানা এক কারণে ম্যুরেল প্রতিস্থাপনকারী শিল্পী চিত্রটির প্রকৃত আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ করেননি । মূল ছবিটা যে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর তোলা তা ম্যুরেলে উল্লেখ থাকলে পুলিশবাহিনীই গৌরবান্বিত হতেন। এতে লুকোচুরির অবকাশ নেই। কুমিল্লা পুলিশবাহিনীর ওপর প্রকাশিত গবেষণামূলক গ্রন্থটির সম্পাদক বাংলা একাডেমীর গবেষণা কর্মকর্তা মামুন সিদ্দিকীও ম্যুরেলে ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধুর ছবিটি যে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর তোলা তাও উল্লেখ করেছেন এর তিন তিনটি সংস্করণেই ।
এ প্রসঙ্গে তরুণ গবেষণা কর্মকর্তা ছোটভাই মামুন সিদ্দিকীকে গত ৩১ মার্চ জিজ্ঞেস করলে বলেন, আলোকচিত্রীর নাম লিপিবদ্ধ করবার কোন বাধ্যবাধকতা ম্যুরেল শিল্পীর ওপর দেয়া হয়নি। শিল্পী একমাত্র সৌজন্যের খাতিরে এবং কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে আলোকচিত্রীর নাম জুড়ে দিতে পারেন ।
তবে তিনি যোগ করেন, একটা সৌজন্যবোধের রীতি হিসেবে আলোকচিত্রীর নাম ব্যবহার করা যেতেই পারে কোন ম্যুরেল স্থাপন করবার সময়ে। শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় পথিকৃৎ কুমিল্লা এ ব্যাপারেও পথিকৃতের ভ’মিকা অবশ্যই নিতে পারে । এ সংক্রান্ত সৌজন্যমূলক রীতি প্রচলন করে ।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ-এর প্রধান কার্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং সাম্প্রতিক সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় পাঠাগার আন্দোলনের অগ্রণী নেতা জিয়াউদ্দিন ঠাকুর এ প্রসঙ্গে বলেন, কুমিল্লার কোন ম্যুরেলেই আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ করা হয়নি ।
জিয়াউদ্দিন ঠাকুর, যিনি “১৯৭১: কুমিল্লা পুলিশলাইনস” গবেষণামূলক মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী-নির্ভর গ্রন্থটির আদি প্রস্তাবকারী, পৌরপার্কে নির্মিত বঙ্গব›ধুর সৌম্যদর্শন ম্যুরেল, বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তনে বা টাউন হলে প্রতিস্থাপিত মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর-এর বিরাট ম্যুরেল বা নজরুল ইন্সটিটিউটের সম্মুখে গড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টিনন্দন ম্যুরেল-এর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন ।
কারো কৃতিত্ব এবং কাজের স্বীকৃতি অস্বীকার করার মধ্যে কোনরূপ গর্বের ছিটেফোঁটাও থাকেনা । তাই আবারো কুমিল্লার ইতিহাসবিদদের এবং সুধী ও সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে ম্যুরেলটিতে মোহাম্মদ ফজলে রাব¦ীর নাম সংযোজন করবার জন্যে বিহিতব্যবস্থা নেওয়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছি । স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে । এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশবাহিনী, কুমিল্লা জেলা অবশ্যই অগ্রণী বা পথীকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন স্বাভাবিকভাবেই । যেমনটি তারা দখলদার পাকী বাহিনী প্রতিরোধে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে । ১৯৭১ সালে ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব।
মোবাইল : ০১৭৩১-৫১২৭২২ ও ০১৫৫২-৩২০৯৫৭