বিস্মৃতির আড়ালে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অখিল চন্দ্র দত্ত

 

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব।।
আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। বাহ্যিক সমস্যা ও অন্তর্নিহিত সমস্যার বেড়াজালে আমরা অনেকেই অতীতকে ভুলতে বসেছি। অতীত সম্পর্কে খানিকটা জানি- তাও বলতে চাই না। কেন বলতে চাই না? এর সদুত্তর খুঁজতে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, বর্তমানে কুমিল্লাতে যারা রাজনীতি করেন তারা শুধু নিজেদের কথাই বলে বেড়ান।

যাঁরা তাদের পরিচয় করে দিলো কিংবা যাঁদের হাত ধরে তারা পরিচিতি লাভ করেছেন সেই ত্যাগী নেতাদের কথা তারা বলেন না কেন? তিনি বলেন, আপনি কার কথা বলতে চাচ্ছেন? বলি, কাজী জহিরুল কাইউম, আজিজ খান, ফয়েজ উল্লাহ, কালাম মজুমদার-এরও আগে ব্যারিস্টার আবদুল রসুল, কমরেড এয়াকুব, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, কামিনী কুমার দত্ত, অতীন্দ্র মোহন রায়, অখিল চন্দ্র দত্ত…। আরে থামেন, থামেন একথা বলে তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন। বলেন, আপনি যাঁদের কথা বলেছেন, তারা প্রত্যেকেই স্বনামে খ্যাত। তাঁদের কথা বললে বর্তমান নেতাদের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে। অবাক চোখে তাকাতে তিনি বলেন, আরে মিঞা বুঝলেন না! আগে যারা নেতৃত্ব দিতেন তারা নিজের কথা ভাবতেন না, অন্যের কল্যাণের কথা ভাবতেন। এখন তো নেতাদের নিজেদের ভাবনার শেষ নেই। দেখছেন না কারা এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন! সব চোর-চুট্টা এখন রাজনীতির জায়গা দখল করে বসে আছে। বলি, ঢালাওভাবে একথা মেনে নেয়া যায় কী? তিনি বলেন, আমি কুমিল্লার আঙ্গিকে বলছি। চরদখলের মতো আমাদের নেতারা যার যার আসন দখল করে বসে আছেন। অন্য নেতাদের প্রবেশ নিষেধ। এহেন পরিস্থিতিতে তারা অতীতকে ভুলে যাবেন কিংবা থাকবেন -এটাই স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন, আপনি অখিল দত্তের কথা বলছিলেন না? বলি, জি¦।

 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, অখিল দত্তের বাড়িটি কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। এ বাড়িটির কোথাও কী অখিল বাবুর চিহ্ন আছে? নেই। বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পরেছে সবকিছু। অকৃতজ্ঞতা কাকে বলে।

 

বয়োবৃদ্ধ এ রাজনৈতিক নেতার সাথে কথা বলতে বলতে রাজগঞ্জ থেকে হেঁটে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। পথযাত্রী বয়োবৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতা কান্দিরপাড় এসে বিধায় নিয়ে সোজা পশ্চিমে চলে গেলেন।

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি এ বাড়ির মালিক অখিলচন্দ্র দত্ত সম্পর্ক জানতে হবে। বহু আগে কে যেন বলেছিল, অখিলচন্দ্র দত্তের জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার (বর্তমান জেলা) কসবা এলাকায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা মনে হতেই বোদ্ধাপাঠক ও লেখক ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদের নাম মানসপটে ভেসে ওঠে। সন্ধ্যায় তাকে ফোন করি। ৩-৪ দিন পর তিনি রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী অখিলচন্দ্র দত্তের সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যসহ দৈনিক শিরোনাম কার্যালয়ে আসেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

কুমিল্লার প্রবীণ আইনজীবী-সাংবাদিক-চিকিৎসকদের নিয়ে একটি গ্রন্থ লেখার প্রস্তাবক সৈয়দ রেজাউর রহমানের কথাও মনে হয়। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ খুবই কঠিন কাজ।

দুই.
বলছি, অখিলচন্দ্র দত্তের কথা। তিনি ১৮৬৯ সালে তৎকালীন মহকুমা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলাধীন চারগাছ এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গোলকচন্দ্র দত্ত। অখিল চন্দ্র দত্ত ১৮৯০ সালে এন্ট্রাস পাস করেন। এরপর কলকাতা থেকে ¯œাতক ও আইনে ¯œাতক পাস করে কুমিল্লা বার-এ ১৮৯৭ সাল থেকে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ভারতীয় আইন সভার ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হন। এর আগে ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁকে প্রথম বক্তৃতা করতে দেখা যায়, ১৯০৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সে বছর তিনি কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯০৭ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের অপরাধে ও আসামি বসন্তকুমার মজুমদারের পক্ষে মামলা চালিয়ে তিনি দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দেন। (অখিলচন্দ্র দত্ত, যাদের জন্মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধন্য, পৃ. ৭০)। ১৯০৯ সালে মোরলি-মিন্টুর শাসন সংস্কারের পরের নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হন। ১৯১৮ সালে চচুঁড়ায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক রাজনৈতিক সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির প্রেসিডেন্টের ভাষণে রাজবন্দিদের উপর নির্মম নির্যাতনকে নির্দোষীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার (ম্যাসাকার অব দি ইননোসেন্ট) আখ্যায়িত করায় সরকার পক্ষ তেকে তুমুল প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু তিলক ও অন্যান্যদের সমর্থনে তিনি তাঁর বক্তব্যে অনড় থাকেন ও দৃঢ়চিত্তের পরিচয় দেন।

১৯২১ সালে গান্ধীজীর নাকে বিলেতী পণ্য বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের বাণী দ্রুত গতিতে সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলাতেও এ প্রতিক্রিয়া প্রবলভাবে দেখা দেয়। সে-সময় কুমিল্লায় কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন অখিলচন্দ্র দত্ত ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী।

সে-বছরই বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ও হাইকোর্টের প্রখ্যাত ব্যারিস্টার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কুমিল্লা শহরে আসেন এবং কুমিল্লা বার-এ এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। অখিল চন্দ্র দত্ত, হরদয়াল নাস, আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, অতীন্দ্র মোহন রায়সহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এ সমাবেশে যোগদান করেন। একই বছর চাঁদপুরে আটকে পড়া চা বাগানের হাজার হাজার কুলির কল্যাণে অখিলচন্দ্র দত্ত এসে দাঁড়ান হরদয়াল নাগের পাশে। কুলি কল্যাণ সমিতির তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট। ১৯২৩ সালে আইন সভায় পুনঃনির্বাচিত হন। একই সালে কুমিল্লায় পাইওনিয়ার ব্যাংকের (ত্রিপুরা) অফিস স্থাপন করেন। তিনিই এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা।

১৯২৩ সালে কুমিল্লায় অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সাথে যুক্ত ছিলেন অখিলচন্দ্র দত্ত, ইন্দুভূষণ দত্ত, নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, বিশে^শ^র চ্যাটার্জি, আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, হাবীবুর রহমান চৌধুরী।

১৯১৬-১৯২৩ সাল পর্যন্ত অখিলচন্দ্র দত্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। ১৯২৮ সালের তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩২-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য ও সহ-সভাপতি ছিলেন। কুমিল্লার আরেক কৃতী সন্তান মফিজ উদ্দিনও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৩০ সালে ঘোষিত লবন আইন অমান্য আন্দোলন সারাদেশে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য গান্ধীজী নিজে যে ৬ জন সত্যাগ্রহী নির্বাচন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুমিল্লার একনিষ্ঠ কংগ্রেস কর্মী হাবীবুর রহমান চৌধুরী। ১৯৩২ সালে শুরু হয় সারা ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন। সরকার তখন কংগ্রেসসহ বহু প্রতিষ্ঠানকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে। তখন কুমিল্লা জেলা কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন হেমাপ্রভা মজুমদার। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হাবীবুর রহমান চৌধুরী। তাদের আটক করে দু’মাস করে জেল দেয়া হয়। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে প্রাদেশিক কংগ্রেসের নেতা অখিলচন্দ্র দত্ত ও তাঁর সহধর্মিণী প্রিয়দা দত্ত গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। অখিল দত্ত পরবর্তীতে আবার নির্বাচিত হয়ে আইন সভার ডেপুটি স্পিকার হন। কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

এদিকে ত্রিপুরা জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী আইন অমান্য করে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন এবং জেলা বোর্ডের ভবনে কংগ্রেসী পতাকা উত্তোলন করেন। এ জন্য তিনি দু’বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হন।

ব্রিটিশের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের প্রশ্নে ১৯৩৪ সালে দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি কংগ্রেসী দল গঠিত হলে অখিলচন্দ্র দত্ত এর সভাপতি মনোনীত হন। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার আসামী পক্ষ সমর্থন করেন। তিনি দেশ ও দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে অন্তর দিয়ে নিজের বলেই উপলব্ধি করতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন প্রতিকারের। অকাতরে নিজস্ব সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির আগেই তিনি নিজ গ্রামে অখিলচন্দ্র দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২ সালে এর নামকরণ হয় এন আই ভূঁঞা উচ্চ বিদ্যালয়। এ প্রসঙ্গে বোদ্ধাপাঠক ও লেখক ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ জানান, কনভেনশন মুসলিমলীগ তথা আইউব-মোনায়েম পন্থী লোকজন এ হীন কাজটি করেছে।

কুমিল্লাতে অখিলচন্দ্র দত্তের বাড়িটি যা ‘দত্ত কুটির’ নামে পরিচিত ছিল তা ১৯৬২ সাল থেকে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড নামে সুপরিচিত, এর প্রধান ফটকের সামনে অখিলচন্দ্র দত্তের ভাস্কর্য নির্মাণের দাবি উঠেছে। এ শিক্ষাবোর্ডের পেছনে কামিনী কুমার দত্তের বাড়িতে তাঁর সহধর্মিণীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মৃণালিনী ছাত্রী নিবাস। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, লেখক আহসানুল কবীর ‘কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন কি’ শীর্ষক একটি ফিচারে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের পেছনের বাড়িটিকে অখিল দত্তের বাড়ি বলে উল্লেখ করেছেন এবং এও বলেছেন এ বাড়িটিতে অখিল চন্দ্রের সহধর্মিণী মৃণালিণী দত্তের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘মৃণালিণী ছাত্রী নিবাস’। লেখক আহসানুল কবীরের দেয়া এই তথ্য সঠিক নয়। প্রকৃত সত্য হলো, এ বাড়িটি ছিল কামিনী কুমার দত্তের। তাঁর স্ত্রী মৃণালিণীর নামে এ ছাত্রী নিবাস স্থাপিত হয়েছে। অখিল দত্তের স্ত্রীর নাম ছিল প্রিয়দা দত্ত। অখিল দত্তকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ আমার আগামী গ্রন্থে সংযোজিত হবে। তাঁর প্রসঙ্গে নতুন তথ্য পেলে অবশ্যই প্রকাশিতব্য প্রবন্ধ আরো ঋদ্ধ হবে। এ ব্যাপারে বিদগ্ধজনদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। কুমিল্লার অহংকার অখিলচন্দ্র দত্ত ১৯৫০ সালে কলকাতায় পরলোকগমন করেন।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।