২০২৪ এর দেয়ালে ছিল আগুনের ভাষা

জাগরণের গ্রাফিতি:

inside post

মনোয়ার হোসেন রতন

আর আজ ২০২৫-এ এসে আমরা কি করছি?

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অথচ আলোকোজ্জ্বল মুহূর্ত। স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতা রাস্তায় নেমেছিল, গর্জেছিল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। সেই উত্তাল সময়ে রক্তে, গুলিতে, কান্নায় আর দ্রোহে লেখা হয়েছিল এক অনবদ্য কাব্য—গ্রাফিতির ভাষায়। দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছিল মানুষের হৃদয়ের প্রতিবাদী ক্যানভাস, যেখানে কেবল রং-তুলি নয়, ফুটে উঠেছিল এক একটি জীবন্ত স্লোগান, ক্ষোভের রক্তাক্ত ছাপ আর স্বাধীনতার আর্তি।

একদিকে রাষ্ট্রশক্তির প্রশ্রয়ে গুম, খুন, লুট, দুর্নীতি আর বৈষম্যের বিষাক্ত শিখা—অন্যদিকে ক্ষুব্ধ, দগ্ধ, নিপীড়িত ছাত্র জনতার শৃঙ্খল ভাঙার ঝনৎকার, তারুণ্যের বিদ্রোহ। সেই দ্রোহের আঁচ লেগেছিল দেয়ালে দেয়ালে—রাস্তায় রাস্তায়।

“তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!”
“চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার!”
“শোনো মহাজন, আমরা অনেক জন।”
“আসছে ফাল্গুনে, আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।”

শিল্পের মতো করে আঁকা এসব স্লোগান শুধু লিখন ছিল না, ছিল তীব্র প্রতিবাদ।

“বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর?”
“আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ খাঁটি গড়তে জানি।”
“স্বজন হারানো শ্মশানে, তোদের চিতা আমি তুলবোই।”
“যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ।”

শহীদদের রক্তে রঞ্জিত দেয়ালগুলো উচ্চারণ করেছে সাহসের বাণী:

“যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার!”
“লাখো শহীদের দামে কেনা, দেশটা কারো বাপের না।”

গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, বৈষম্যবিরোধিতা, সুশাসনের আহ্বান—

“বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার আদিবাসী সুরক্ষার দায়িত্ব সবার।”
“আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের কোন ঠাঁই নাই।”

কোটা সংস্কার, মেধার মর্যাদা এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবিও লেখা হয়েছে সাহসের অক্ষরে—

“তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে?”
“কোটা না মেধা? মেধা, মেধা।”
“এক দফা, দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক।”

রাষ্ট্রের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে উঠেছিল তীব্র ব্যঙ্গ, স্পষ্ট প্রতিরোধ—

“কে এসেছে? কে এসেছে? পুলিশ এসেছে, কি করছে? স্বৈরাচারের পা চাটছে।”
“আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে।”
“ছি: ছি: ছি থু থু থু।”
“১ ২ ৩ ৪ শেখ হাসিনা তুই গদি ছাড়।”

শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইয়ামিন, আহানাফ, রাফি, আলভী, নাফিজ, রুদ্র সেন, রিয়া গোপসহ অসংখ্য প্রাণের রক্ত মিশে গিয়েছিল কাদামাটিতে। তাদের স্মরণেই লেখা হয়েছিল:

“৫২ দেখিনি! ৭১ দেখিনি! দেখিছি২৪!”
“লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছেড়ে দে।”
“আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের কোন ঠাঁই নাই।”

তারা বেঁচে ছিলেন আগুন হয়ে। তারা মরেননি—

“যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার!”

কিন্তু আজ ২০২৫-এর জুলাই-আগস্টে দাঁড়িয়ে আমরা কী করছি? দেয়ালগুলো আবার ধোয়া হয়েছে, বিভক্ত এবং বিভাজনের রাজনীতিতে, এখন সেখানে রঙচঙে দলীয় বিজ্ঞাপন। সেই জ্বলন্ত স্লোগান আজ নির্বাক। শহীদদের মুখে কেউ আর নাম নেয় না, বরং অনেকে প্রশ্ন তোলে—এত যুদ্ধ

করে কী পেলাম?

আমরা কি আবার নির্বিকার হয়ে যাচ্ছি?
তখন যারা গলা ফাটিয়ে বলেছিল—

“স্বৈরাচার, স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়!” আজ তাদের কেউ কেউ চাকরির আবেদনপত্রে আবার পুরনো আত্মজীবনী লিখছে। তখন যারা বলেছিল—
“আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম, সংগ্রাম!” আজ তারা আপসে আপসে ক্ষমতার সাথে হাসছে।

দেয়ালের সেই আগুন কি নিভে গেছে? না, আগুন নিভে না। আগুন ছাই হয়, কিন্তু ছাইয়ের নিচে লুকিয়ে থাকে আরও বড় বিস্ফোরণ। আজ প্রশ্ন একটাই—আমরা কি শহীদের ঋণ ভুলে গেছি? আমরা কি সেই দেয়ালগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার বলবো—

“সুবোধ, ভোর হয়ে গেছে।”
নাকি বলবো—
“সুবোধ, কবে হবে ভোর?”

জাগরণ হয়েছিল। দেয়াল ছিল আগুনের ভাষা। আজ যদি আমরা সেই আগুনকে শুধুই ইতিহাস মনে করি, তবে ভবিষ্যত আমাদের ক্ষমা করবে না। আবার লেখ, দেয়ালে নয়—চেতনায়।

আরো পড়ুন