কে ডাকে নিশীথ রাতে
।। আবদুল আজিজ মাসুদ ।।
“জাগো জাগো মোমিনো/ওয়াক্তে সেহেরি হোগিয়া”। ষাট-সত্তর দশকে রমজানের গভীর রাতে উর্দুলফ্সে শুনা এ কাসিদা শৈশবে অনুরণন হতো মনে। আহ্ কি সুরেলা মধুর কন্ঠের ডাক। আজো কানে বাজে। কার সাধ্যি এমন ডাক শুনে বেঘোরে ঘুমায়। মনে পড়ে শীতের রোজায় যখন মাঝ রাতে হেঁশেলে গৃহকর্মীর সাথে ভাত রান্নায় আগুন উসকে দিতে কাঠের ভূষি ছিটাতাম উনুনে। আর কান পেতে শুনতাম দূর কোন গলি, মহল্লা থেকে ভেসে আসা, ‘জাগো মা বোনেরা সময় বহিয়া যায়’, ‘খুশিরো পয়গাম নিয়ে রোজা আইলোরে।’ আরো কতো কি অজানা শিল্পীর ইসলামি গান রোজার শেষ দশকে গাওয়া হতো করুণ সুরে রোজা বিদায়ের গান। “মোমিন মুসলমান চইলা গেলো- রমজানেরো চাঁন, আল বিদাহ্ হে মাহে রমজান।” তখন মনে কৌতুহল হতো কে গায় এমন মোহন সুরে কাসিদা, গজল? অতিক্রান্ত কৈশোরে জেনেছি এরা আর কেউ নন আমাদেরই মোগলটুলী মহল্লার- জুম্মন ভাই, জামাল ভাইসহ আরো নাম না জানা অনেকে।
জুম্মন ভাই ছিলেন ঐহিত্যবাহী শাহ্ সুজা মসজিদের মুয়াজ্জিন আনোয়ারুল হক কালা মিঞার অকৃতদার সন্তান। কালা মিঞার পূর্ব পুরুষগণ বংশ পরম্পরায় শাহ্ সুজা মসজিদে মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে। কালা মিঞার দাদা মগলু খান ভারতের কাশ্মীর থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। এরা সকলেই গত হয়েছেন। মাইকে আজান প্রচলনের আগে মিনার থেকে কালা মিঞার সুললিত কন্ঠের আজান দক্ষিণে চর্থা, উত্তরে মাঝি গাছা থেকেও শুনা যেত বলে চাক্ষুস স্বাক্ষী আছে এখনো। তখনতো আর এখনকার মতো বহুতল ভবনের জঞ্জাল ছিল না, তাই হয়তো।
মুরব্বিদের কাছে শুনা কথা, মাইক বিহীন ষাটের দশকে শাহ্ সুজা মসজিদের খাদেম মুর্শিদাবাদী মরহুম আল্লা রাখার শ^শুর বজলু মিঞা, রোজাদারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ডেকে ঘুম ভাঙ্গাতেন। জনৈক আল্লাহ্র বান্দা আসতেন ঘুঙুর বাঁধা লাঠি আর হাতে লন্ঠন নিয়ে। ক্লান্তিহীনভাবে ডেকে যেতেন, ‘সময় সংকীর্ণ সেহেরী খাওয়ার সময় হয়েছে’ মাইকের প্রচলন হলে মাইক নিয়ে গভীর রাতে বের হতেন মোগলটুলীর ব্যবসায়ী চানপুরের মফিজ মিঞা, অনেকে পাগলা মফিজ বলতো। এক সময় মোগলটুলী ছিল হোটেল, রেস্ট হাউস আর মেসে ভরা। শহরবাসী ভালো হোটেলে খেতে চাইলে মোগলটুলীকেই চ্যুজ করতো। হোটেলের মধ্যে হাসেমিয়া, দুলালিয়া, আনসারিয়া, তাজমহল, গোমতী হোটেল। কালা মিঞার হোটেল তো সারা রাতই খোলা থাকতো। রমজানে মেস মেম্বাররা সেহেরি খাওয়ার অর্ডার দিয়ে রাখতো সন্ধ্যা রাতেই। আনসারিয়া ছাড়া সবই এখন কালের ¯্রােতে বিলীন। বিখ্যাত হাড্ডিশাহ্ এর তেহারি ছাড়াতো কোন কোন পরিবারের ইফতারই পূর্ণতা পেতনা। সেই তেহারি ঘরের মালিক বাবুর্চি কাপ্তান বাজারের মফিজ মিঞাও নেই, সেই স্বাদও নেই।
নজরুলের সেই বিখ্যাত গান “রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” কোথাও বাজলে মনে হতো কাল ঈদ। সাতাইশার পরপরই চাঁনপুরের বাজিওয়ালা বাড়িতে চলতো ক্লান্তিহীন বাজি তৈরির ব্যস্ততা। বাজির বোঝা নিয়ে রাজগঞ্জ, ছাতিপট্টি, কাপড়িয়া পট্টিতে পসরা সাজাতো। আরো থাকতো কাগজের রঙিন টুপি। মৌসুমী ব্যবসা। শিশু কিশোরদের কেনা কাটায় মহা ব্যস্ততা।
ইফতারের সময় শাহসুজা মসজিদ প্রাঙ্গণে থেকে গোল্লা (আতশবাজি) ফুটাতে আসতো শে^^তশুভ্র বাবরি চুল আর লম্বা দাড়ি গোঁফওয়ালা আরব্য উপন্যাসের যাদু জানা বৃদ্ধের মতো জনৈক ব্যক্তি, যাকে দেখতাম শিল্পকলার সম্মুখে (তখন গণপূর্তের গুদাম ছিল) বট বৃক্ষ আর সিরফুটি গাছের ছায়ায় চাকাওয়ালা টং ঘরে হরিণের চামড়া, বনরুইয়ের আঁশ, বাঘ ভাল্লুকের নখ, ভাগ্য গণনার গুটি, তাবিজ-কবজ সাজিয়ে বসে থাকতে। সাবধানে দূর থেকে বাশেঁর আগায় আগুন দিয়ে পটকা ফুটাতো আমরা দূর থেকে কান চেপে এ দৃশ্য দেখতাম। প্রচন্ড শব্দে পটকা ফুটলে দেখতে আসা শিশু কিশোররা হৈ হুল্লুড় করে যার যার বাসায় ফিরতো। রাজগঞ্জে উচু বাঁশের আগায় ‘মেওয়ালা মুন্সি’ বৈদ্যুতিক লাল বাতি জ¦ালাতো। কালেক্টরেট বিল্ডিং থেকে সাইরেন বাজতো, এখনো বাজায়। পরে আমাদের শাহ্ সুজা মসজিদেও সাইরেন এলো, এখনো আছে। বর্তমানে আধুনিক ডিজিটাল যুগে এ সব অনেক অপ্রয়োজনীয় কানের কাছে মোবাইলে জানান দেয় সেহেরি-ইফতারের ঘন্টা ধ্বনি। তবুও আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলি কেমনে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। মোবাইলঃ ০১৭১১৪৬৪২১৩।