নীল রঙের ঈদ!

-মো.ইলিয়াছ হোসাইন

আকাশে আষাঢ়ের ঘনঘটা। মেঘের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলছে বারো বছরের এক কিশোরী। বাবা নবীজির ধনী স্ত্রীর সাথে তার নাম মিলিয়ে রেখেছেন বিবি খাদিজা।
মাঠে আউশের পাকা ধান। ধানের গন্ধে ব্যাকুল গ্রামের মাঠ-ঘাট। কেউ ধান কেটে বাড়ির উঠোনে আনছে আবার কেউ পরে আনবে। চার দিন পর রোজার ঈদ। সবাই ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত। খাদিজার বান্ধবী নতুন জামা কিনে এনে তাকে দেখাচ্ছে। কিছু বন্ধু বলাবলি করছে আমার নতুন জামা টাঙের ভেতর মা রেখে দিয়েছে দেখে ফেললে ঈদ শেষ হয়ে যাবে!
খাদিজার ঈদ এখনো শুরু হয়নি। বাবা বলেছেন- ধান কেটে টাকা পেলে জামা কিনে দেবে। খাদিজার আরো ছোট চার ভাই-বোন। তাদেরকেও বাবা তাই বলেছে। ঈদের আনন্দ খাদিজার চোখে-মুখে আষাঢ়ের মেঘের মতো উড়ছে। শুধু ছুঁতে পারছেনা। একদিন চলে গেলো। ঈদের আর বাকি তিন দিন। ঘুম থেকে উঠে দেখে বাবা নাই,ফজরের নামাজ পড়ে কাঁচি নিয়ে ধান কাটতে ক্ষেতে চলে গেছেন। অন্যের ধান কেটে যা পায় সে টাকায় সংসার চলে খাদিজাদের। দুপুর নামার সাথে সাথে বাবা চলে আসলো কিন্তু টাকা পায়নি। বাবা আবার আশা দিয়েছে কালকে টাকা পেলেই বাজারে নিয়ে যাবে। খাদিজার মনে অনেক আনন্দ। ভাই-বোন সবাই মিলে খুশিতে আত্মহারা। ঈদে নতুন জামা কিনবে। নতুন জামা গায়ে দিয়ে সবাই মিলে কমলা রঙের আইসক্রিম খাবে। ঠোঁট রাঙাবে। বেনি করা চুলে হলুদ ফিতা বাঁধবে। মাটির পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল-চুলো;আরো কতো কি কিনবে। রাত শেষে আরেকটি সূর্য। আর মাত্র ঈদের দু’দিন বাকি। বাবা আজও বাজারে নিয়ে গেলোনা। মাকে বলতেই বললো- বাবা টাকা পেলে নিয়ে যাবে। ধৈর্য ধর। কিন্তু ধৈর্য কী এতো সহজ ব্যাপার;বারো বছর বয়সে ধরা যায়? পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর মেয়েটি বসা; আকাশ দেখছে। একদল সাদা বকপাখি আকাশে পাখা মেলে উড়ছে। সে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে পাখির দলে যোগ দিতে কিন্তু উড়বার তার ডানা নাই।
আগামীকাল ঈদ। আকাশে চিকন চাঁদ উঁকি দিয়েছে;খাদিজাদের ভাঙা ঘরের চালের ফাঁক দিয়েও
ঈদের চাঁদ পরিষ্কার দেখা যায়। চারদিকে চাঁদ দেখার হৈ-হুল্লুর চিৎকার।
আকাশে চাঁদ দেখা দিলেও খাদিজার মনে চাঁদ উঠেনি।
বাবা জামা আনেননি। বিকেলের আলো নিভে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু খাদিজাদের বাবারা শুধু চোখ ভেজা আশা দিয়ে যায়;তাঁদের রাজকুমারীদের জন্য নতুন জামা নিয়ে ঘরে ফিরেনা! অপেক্ষা করতে করতে বেদনার চোখে খাদিজা ডুবে গেলো ঘুমের দেশে।

ততক্ষণে রাতের জোনাকিরা মিটমিটে আলোর আসর জমালো। পৃথিবীর শরীরে চাঁদ ঢেলে দিলো পরিপাটি জোছনা। জোছনার ফকফকে স্নিগ্ধ আলোর উপর নীল রঙের জামা পড়া একটা মেয়ে;দেখতে একেবারই নীলপরী! বাবা আদর করে তার কপালে চুমু খেয়ে বলছে- আমার রাজকুমারী মা,জামা পছন্দ হয়েছে?
রাজকুমারী মাথা নেড়ে উত্তর দিলো-হ্যাঁ হয়েছে।
আমার সাথে মেলায় যাবে?
দ্বিতীয়বার মাথা নেড়ে বললো,হ্যাঁ যাবো!
ঈদের দিন কি কি করবে?
রাজকুমারী উত্তর দিলো:বন্ধুরা মিলে দু’টাকা দিয়ে কমলা রঙের আইসক্রিম খাবো;দশটাকা দিয়ে পুতুল আর পাঁচ টাকার হলুদ ফিতা কিনবো।
(গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।)
লেখক: আলোকচিত্রী।