নাঙ্গলকোট: ঐতিহ্যের মাটিতে আধুনিকতার স্বপ্ন


মনোয়ার হোসেন রতন।।
নাঙ্গলকোট—এটা কেবল একটি উপজেলার নাম নয়; এটি একধরনের আবেগ, ইতিহাস আর সম্ভাবনার মাটিতে গড়ে ওঠা একটি স্বপ্নের জনপদ। কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশে সবুজ ধানক্ষেত, কাকডাকা ভোরে পাখির কলতান, কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামের মেঠোপথ আর সন্ধ্যায় কুপি-জ্বলা ঘরের আলো ছাড়িয়ে আজ যখন এই জনপদ আলোকিত শহুরে সম্ভাবনার আলোয় এগিয়ে চলে—তখন ইতিহাস ও ভবিষ্যতের এক অপূর্ব মিলনরেখা আঁকা হয় তার মাটিতে।
প্রকৃতি ও ইতিহাসের সংলাপ
নাঙ্গলকোটের প্রকৃতি যেন কবির কলমে আঁকা এক কাব্যিক চিত্র। হাওরের মতো বিস্তৃত মাঠ, কলাপাতা ঘেরা পুকুরঘাট, গ্রামের প্রান্তজুড়ে নানান বৃক্ষের সবুজ ছায়া—সব মিলিয়ে এক শান্ত, নিরব ছন্দে গাঁথা জীবনচিত্র। এখানে শীতের সকালে শিশিরভেজা ধানের শীষ যেমন প্রাণ জাগায়, বর্ষার সন্ধ্যায় ধ্বনি যেন হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসে।
এই মাটির বুকে জন্ম নিয়েছেন বহু প্রখ্যাত সন্তান—যাঁরা কেবল স্থানীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেননি, ছড়িয়ে পড়েছেন দেশ-বিদেশে। চিকিৎসা, শিক্ষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, প্রশাসন, প্রবাস কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁরা গড়ে তুলেছেন এক অনন্য পরিচয়। তাঁদের পথ ধরে আজকের প্রজন্মও স্বপ্ন দেখে এক নতুন নাঙ্গলকোটের।
প্রশাসনিক কাঠামো ও সেবাব্যবস্থা
নাঙ্গলকোট উপজেলা বর্তমানে ১৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। প্রত্যেকটি ইউনিয়নে স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ ও অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনের মাধ্যমে সেবার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। নাগরিক সেবায় ডিজিটাল রূপান্তর, জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে ট্রেড লাইসেন্স—সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয়।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
নাঙ্গলকোটে শিক্ষার হার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ ও মাদ্রাসা—সবখানেই শিক্ষার্থীদের পদচারণা চোখে পড়ার মতো। একটি সরকারি ডিগ্রি কলেজ ছাড়াও বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তরুণদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করছে। নারী শিক্ষায়ও হয়েছে বিপ্লব; আগে যেখানে মেয়েরা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারত না, আজ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সরকারি চাকরিতে পদচারণা করছে।
অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান
নাঙ্গলকোটের অর্থনীতি একসময় পুরোপুরি কৃষিনির্ভর থাকলেও এখন তা বহুমাত্রিক রূপ পেয়েছে। ধান, শাকসবজি, ফলমূলের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামারও বড় ভূমিকা রাখছে। প্রবাসীদের রেমিটেন্স এ অঞ্চলের উন্নয়নে এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সাহসী উদ্যোক্তা অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন—এ উদ্যোগ শুধু পণ্যের নয়, স্বপ্নেরও আদান-প্রদান ঘটাচ্ছে।
প্রযুক্তি ও তারুণ্যের নেতৃত্ব
ইন্টারনেট সুবিধা, স্মার্টফোনের ব্যবহার, এবং অনলাইন শিক্ষার প্রসারে এখন গ্রামেও ডিজিটাল শিক্ষার আলো পৌঁছে গেছে। ফ্রিল্যান্সিং, ইউটিউব কনটেন্ট নির্মাণ, ডিজিটাল মার্কেটিং—নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তিকে রপ্ত করে গড়ে তুলছে নিজের কর্মক্ষেত্র। নারী উদ্যোক্তারা ঘরে বসেই চালাচ্ছেন হোম কিচেন, অনলাইন কাপড় বিক্রি কিংবা হ্যান্ডিক্র্যাফট—যা অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে।
সংস্কৃতি ও মানবিক সমাজচিত্র
নাঙ্গলকোটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জীবন্ত। বাউল গান, পালাগান, নাচ, নাটক—এই উপকরণগুলো এখনও হারিয়ে যায়নি। ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক অনুষ্ঠান ও লোকজ ঐতিহ্য এখনো এখানকার মানুষের জীবনধারার সঙ্গে মিশে আছে।
তারুণ্যনির্ভর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যেমন—ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প, বৃক্ষরোপণ, দরিদ্র সহায়তা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ—এই জনপদে মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করছে।
আধুনিক নাঙ্গলকোট গড়ার প্রস্তাবনা
১. একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
২. আইটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ইনোভেশন হাব গড়ে তোলা
৩. আধুনিক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন
৪. মাতৃ ও শিশু সেবা হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র
৫. নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি অনুদান ও স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা
৬. উন্নত গণপরিবহন ও সড়ক অবকাঠামোর বিস্তার
৭. একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প পার্ক বা ক্ষুদ্র শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলা।
নাঙ্গলকোট আর কেবল একটি প্রান্তিক জনপদ নয়—এটি এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের ছায়াপথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা এক আলোকিত অধ্যায়। এই উপজেলার সন্তানরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন দায়িত্বশীল হচ্ছে, নারী-পুরুষ একসাথে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রযুক্তির প্রয়োগ ও মানবিক উন্নয়নের মেলবন্ধনে গড়ে উঠুক নতুন নাঙ্গলকোট—যা আগামী দিনের মডেল উপজেলা হবে, এই আমাদের স্বপ্ন, আমাদের অঙ্গীকার।