রাষ্ট্রের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কুমিল্লার মানুষ

 

inside post

মনোয়ার হোসেন রতন।।

ময়নামতির স্তব্ধতা, শালবনের মৃদু হাওয়া আর কান্দিরপাড়ের কোলাহল—এ তিনেই লুকিয়ে আছে কুমিল্লার এক আত্মিক পরিচয়। এ জনপদ কেবল ইতিহাস নয়, এক বিস্মৃত গৌরবের দলিল। মেঘনার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ জেলা একসময় ছিল বিদ্যাচর্চা, সংস্কৃতি আর সৃজনশীলতার আলোকবর্তিকা। কিন্তু একুশ শতকের রাষ্ট্রযন্ত্রের গতি যতই বেড়েছে, ততই যেন পেছনে পড়ে থেকেছে কুমিল্লা—বঞ্চনা আর প্রতিশ্রুতির মিছিলে হারিয়েছে বাস্তবতার ছোঁয়া।

একসময় কুমিল্লা ছিল জ্ঞানের তীর্থভূমি। ভিক্টোরিয়া কলেজ, টাউন হল কিংবা কান্দিরপাড়ের সাহিত্যচক্র—এসব ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক আলোয় দীপ্ত এক জনপদ। মুরাদনগরের কোন পল্লীতে কোনো এক বাউল যখন গাইতেন ধানের গান, তখনই জন্ম নিত এক অদৃশ্য কবিতার শহর—যা শুধু শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়ত মাটি ও মানুষের হৃদয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের কল্পিত উন্নয়নের ধারায় আজ এ কুমিল্লা প্রান্তিক এক বিস্মৃত সীমানা—যেখানে রাস্তাঘাট হয়েছে, কিন্তু মানুষের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া আসেনি।

দাউদকান্দির মেঘনা তীরে গার্মেন্টসের পাশে হাজারো শ্রমিক আজও ন্যায্য মজুরির জন্য অপেক্ষমাণ। তিতাসের বুক চিরে দেশের রাজধানীতে পৌঁছে যাচ্ছে গ্যাস, অথচ তিতাসবাসীর ঘরে চুলা জ্বলে না। ব্রাহ্মণপাড়া, হোমনা কিংবা বরুড়ার জনপদ—যেখানে একদিন মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত শপথ উচ্চারিত হয়েছিল, আজ সেখানেই নিভু নিভু করছে ন্যায়ের দীপশিখা।

চৌদ্দগ্রামের কৃষক ধান কাটেন, কিন্তু বাজারে গিয়ে পান না লাভের মুখ। অথচ ঢাকায় ফাইলের পৃষ্ঠায় ফুটে ওঠে ‘কৃষিতে বিপ্লব’ শিরোনাম। মুরাদনগরের এক ছাত্র মেধাবৃত্তির যোগ্য, কিন্তু তার ‘চেনাজানা না থাকা’ই তার সর্বনাশের কারণ। দেবিদ্বারের একজন অটোরিকশা চালক লাইসেন্স পেতে দালালের পেছনে হিমশিম খান। এ দৃশ্যগুলো শুধুই দৃষ্টান্ত নয়—এ গুলোই কুমিল্লার “আমোদ” পত্রিকার সংবাদে উঠে আসে  প্রতিদিন।

রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটা এক ধরনের চুক্তি—আমরা কর দিই, আইন মানি, ভোট দিই; বিনিময়ে প্রত্যাশা করি সেবা, সম্মান আর নিরাপত্তা। কিন্তু এ চুক্তি বারবার একতরফা থেকে গেছে কুমিল্লার জন্য। চান্দিনার শিক্ষার্থী জানে না তার অধিকারের কথা, জানে শুধু কলেজে ভর্তির জন্য ‘সুপারিশের চিঠি’ জোগাড় করতে হয়। মেঘনাপাড়ের এক জেলে জানেন না সংবিধানের ধারা, জানেন শুধু তল্লাশি, জরিমানা আর হয়রানি।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও কুমিল্লা আজো বঞ্চিত। যে রাজনীতি একসময় ছিল গণমানুষের কণ্ঠস্বর, তা এখন হয়ে উঠেছে কেবল নির্বাচন-পূর্ব নাটকের অংশ। মুরাদনগরের মঞ্চে নেতারা উঠে প্রতিশ্রুতি দেন, আর নির্বাচনের পর সেই প্রতিশ্রুতি মিশে যায় হোমনার রাস্তায় উড়ন্ত ধুলোর সঙ্গে। ব্যালটের রাজনীতি থাকলেও, প্রতিদিনের জীবনের লড়াইয়ে মানুষ থাকে একা—নির্জন ও অবহেলিত।

শুধু অবকাঠামো নয়, আজকের সংকট আরও গভীর—নৈতিকতা ও মানবিকতার অনুপস্থিতি। সরকারি অফিস মানেই ‘হয়রানি’। স্বাস্থ্য মানে শুধু ব্যয় নয়, ভয়। শিক্ষা মানে নয় দক্ষতা, বরং পরীক্ষার চাপে কুঁকড়ে যাওয়া এক প্রজন্ম। চৌদ্দগ্রামের এক গরিব রোগীর কাছে হাসপাতালের গেট মানে আরোগ্য নয়, এক অনন্ত অবসাদ।

তবুও—এ অন্ধকারে কিছু আলো দেখা যায়। মনোহরগঞ্জের এক নারী নিজের ঘরে গড়ে তুলেছেন একটি ছোট পাঠশালা। হোমনার এক সাংবাদিক জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দুর্নীতির খবর তুলে ধরেন। চান্দিনার এক শিক্ষক নিজের দারিদ্র্য ভুলে গিয়ে প্রতিদিন পাঠদান করেন নৈতিকতা নিয়ে। এ মানুষ গুলো আছেন বলেই এখনও বিশ্বাস করি—রাষ্ট্র মানে কেবল নিপীড়ন নয়, রাষ্ট্র মানে হতে পারে আশ্রয়, ভালোবাসা, সম্মান।

আমরা কুমিল্লাবাসী চাই:

  • এমন একটি উন্নয়ন, যেখানে দাউদকান্দির শিশুর স্কুলযাত্রা হবে প্রকৃত ‘মেগা প্রজেক্ট’।
  • এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যেখানে চৌদ্দগ্রামের রোগী সরকারি হাসপাতালে নিঃশুল্ক চিকিৎসা পাবে—ভয় পাবে না দালাল বা ওষুধের দোকান।
  • এমন কৃষিনীতি, যেখানে দেবিদ্বারের কৃষকের ধান লোকসানের প্রতীক নয়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বাহক হবে।
  • এমন এক সরকারব্যবস্থা, যেখানে একজন অটোরিকশা চালকও গর্ব করে বলবে, “এ রাষ্ট্র আমার।”

এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—রাষ্ট্র কেন? উন্নয়নের মানে কী? শাসন কাদের জন্য?

আমরা আর চাই না শুধু বক্তৃতা—আমরা চাই বাস্তবতা। আমরা আর চাই না পোস্টারে লেখা প্রতিশ্রুতি—আমরা চাই জীবনের প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সহমর্মিতা।

ময়নামতির স্তব্ধ মাটি আজও সেই প্রশ্নই তোলে—রাষ্ট্র কি কেবল রাজধানীর খুঁটি, নাকি কান্দিরপাড়ের মানুষও তার অন্তর্গত? শালবনের পাতা কাঁপছে বাতাসে—আশায় না আশঙ্কায়, জানি না। কিন্তু আমরা জানি—কুমিল্লা জেগে উঠবে।
কারণ, এ মাটি শুধু ইতিহাস নয়—এ মাটি ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। এ মাটি প্রতিশ্রুতি দেয়, সংগ্রামের; আর কুমিল্লার মানুষ জানে—প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবে পরিণত করতে হয়।

আরো পড়ুন