গণহত্যাকারীদের দোসরদের কৌশল ও জাতীয় সংকট

পাঁচ আগস্ট-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ :
মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পাঁচ আগস্ট ২০২৪ এক অনিবার্য ও তাৎপর্যময় তারিখ। এই তারিখের পর দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এমন সব ঘটনাপ্রবাহ ঘটেছে, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচারের ধারা এবং জনগণের ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষত, গণহত্যাকারীদের দোসররা চারটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও কৌশল নিয়ে সক্রিয় হয়েছে—যা বর্তমান সংকটের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
১. জুলাই বিপ্লব হাইজ্যাক — গণআন্দোলনের কণ্ঠরোধ
জুলাই বিপ্লব ছিল গণমানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও ন্যায়বিচারের দাবির শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু পাঁচ আগস্টের পর কিছু গোষ্ঠী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বিকৃত করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিদেশি লবিং, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া কন্টেন্ট ছড়িয়ে আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা একই রকম কৌশল নিয়েছিল—আন্দোলনের নেতৃত্ব বদলে দেওয়া, মূল স্লোগান বিকৃত করা, জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। আজকের জুলাই বিপ্লব হাইজ্যাক প্রচেষ্টা সেই পুরনো ষড়যন্ত্রের আধুনিক রূপ।
২. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভেদ নতুন নয়, তবে পাঁচ আগস্টের পর এটি যেন পরিকল্পিতভাবে চরমে পৌঁছেছে। গণহত্যাকারীদের দোসররা জানে—ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি থাকলে তারা বিচারের মুখোমুখি পড়বে। তাই দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস, অপবাদ এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গোপন বৈঠকের তথ্য ফাঁস, গুজব ছড়ানো, এবং মিডিয়ায় একে অপরকে দোষারোপ—এসবই তাদের কৌশলের অংশ। ১৯৭৫ সালের পরও রাজনৈতিক বিভেদ বাড়িয়ে একদলীয় শাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার পরিণতি ভুগেছে পুরো জাতি।
৩. অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যর্থ শাসক প্রমাণের প্রচেষ্টা
গণহত্যাকারীদের দোসররা জানে—অন্তবর্তীকালীন সরকার সফল হলে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। তাই প্রশাসনিক ত্রুটি বড় করে দেখানো, ভুয়া অর্থনৈতিক সংকটের খবর ছড়ানো, এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রচার চালানো হচ্ছে।
প্রশাসনিক সামান্য ভুল হলেও তা বহুগুণে বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা হচ্ছে, যাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৯০–এর পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকার–এর ক্ষেত্রেও একই ধরনের চেষ্টা হয়েছিল, যদিও তখন তা ব্যর্থ হয়।
৪. নির্বাচনের দোহাই দিয়ে দেশকে অকার্যকর ও অস্থিতিশীল করা
গণহত্যার বিচার বন্ধের সবচেয়ে বড় অজুহাত হচ্ছে “নির্বাচন”। এই অজুহাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য। নির্বাচনী বিতর্ক, ভোটার তালিকা নিয়ে বিরোধ, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা সংকট—এসব ইস্যুকে বড় করে তুলে ধরা হচ্ছে।
১৯৭১–এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত করতেও অনুরূপ কৌশল নেওয়া হয়েছিল—রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে বিচার রোধ করা। বর্তমান পরিস্থিতি সেই কৌশলেরই পুনরাবৃত্তি।
জাতীয় সংকট ও করণীয়
এই চারটি চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র, এবং বিচার ব্যবস্থার জন্য ভয়ংকর হুমকি।
- প্রথমত, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে—রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, প্রবাসী বাংলাদেশিদের একত্রে কাজ করতে হবে।
- দ্বিতীয়ত, ভুয়া প্রচারণা মোকাবিলায় তথ্য–যুদ্ধ জোরদার করতে হবে।
- তৃতীয়ত, অন্তবর্তীকালীন সরকারের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণের আস্থা অটুট থাকে।
- চতুর্থত, নির্বাচন ও বিচার প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে চালাতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ অজুহাত দাঁড় করাতে না পারে।
- পাঁচ আগস্ট ২০২৪–এর পরবর্তী পরিস্থিতি কেবল রাজনৈতিক পরীক্ষা নয়—এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মুহূর্ত। গণহত্যাকারীদের দোসররা যে চারটি কৌশল নিয়েছে, তা যদি সময়মতো শনাক্ত ও প্রতিহত না করা যায়, তবে আমরা আবারও ইতিহাসের এক ভয়াবহ পুনরাবৃত্তির মুখোমুখি হব।
আমাদের ১৯৭১ ও ১৯৭৫–এর শিক্ষাগুলো মনে রাখতে হবে—যেখানে বিভেদ, প্রোপাগান্ডা ও অস্থিতিশীলতা একটি জাতিকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। এবার আমাদের সেই ভুল আর করা যাবে না।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর্কাইভস — “১৯৭১: ষড়যন্ত্র ও প্রতিরোধ”।
২. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রিপোর্ট — আগস্ট–ডিসেম্বর ২০২৪।
৩. বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভ — “১৯৭৫–১৯৯০: রাজনৈতিক বিভেদ ও শাসনব্যর্থতা”।
৪. সমকালীন গণমাধ্যম প্রতিবেদন — জুলাই–আগস্ট ২০২৪।
