ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়

বাহার উদ্দিন খান।।
৭৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী দেবিদ্বারের মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়। উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে অসংখ্য কৃতী শিক্ষার্থী উপহার দিয়েছে। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাবিত ম্যানেজিং কমিটি, আর্থিক সংকট, শিক্ষক সংকট এবং শিক্ষার মান অবনতির কারণে বিদ্যালয়টি বর্তমানে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২৩৪ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করেছে মাত্র ১৪১ জন। অর্থাৎ পাশের হার নেমে এসেছে ৬১ শতাংশে, জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী। তবে এই রুগ্নদশা থেকে উত্তরণে বিদ্যালয়ের এডহক কমিটি সম্প্রতি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
বিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২ একর ২৩ শতক জায়গার ওপর ১৯৪৮ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯৮০ সালে এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১১৩৯ জন। এর বিপরীতে ৩ জন পার্ট-টাইম শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক সংখ্যা মাত্র ২৪ জন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিদ্যালয়ে একটি দ্বি-তলা ও একটি একতলা ভবনে ক্লাস চালানো হয়। এর মধ্যে কয়েকটি শ্রেণীকক্ষে পানি পড়ে।
নাজুক অবস্থার পেছনে নানা কারণ
সূত্র জানায়, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষককে নিয়ে মামলাজনিত জটিলতা, ম্যানেজিং কমিটিতে রাজনৈতিক প্রভাব এবং বিগত কমিটিগুলোর চরম অব্যবস্থাপনাকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শিক্ষক সংকট, পাঠাগারে বই না থাকা, বিজ্ঞানাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব এবং কম্পিউটার ল্যাবের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি অচল হয়ে যাওয়াও এ অবস্থার পেছনে বড় কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি বুয়েটের অধ্যাপক মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, বিদ্যালয়টির আর্থিক অবস্থা বর্তমানে তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। পাশাপাশি, বিগত সময়ে নানান অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শিক্ষার মানে চরম অবনতি
একসময়ের সেরা বিদ্যালয়টি বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি শিক্ষার মানের চরম অবনতিতে পড়েছে। আগে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬০০ থেকে ১৭০০ জন, সেখানে এখন ১১৩৯ জনে নেমে এসেছে। ফলাফলও দিনদিন অবনতির দিকে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানান, একসময় যে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাকে সবাই অগ্রাধিকার দিতেন, এখন সেখানে ভর্তির প্রবণতা কমে গেছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বিদ্যালয়ের মান আরও নেমে যাবে।
বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক রফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার কারণে স্কুলটির আজ এ অবস্থা। এর ফলে এখানে সন্তানদের পড়ানোর মানসিকতা অভিভাবকরা ক্রমেই হারাচ্ছেন। তাই মানোন্নয়নে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
পরিস্থিতি উত্তরণে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিদ্যালয়ের এডহক কমিটি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সব ধরনের লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে করা হচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন ও ফি আদায়ও ব্যাংকের মাধ্যমে হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করে একাডেমিক পরিবেশ উন্নয়নে নানা কমিটি গঠন করা হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নতুন একটি ভবন নির্মাণের অনুমোদন হয়েছে। শিক্ষক সংকট কাটাতে ৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান ক্লাব, কম্পিউটার ক্লাব, গণিত ক্লাব, ডিবেট ক্লাব, বয়েজ স্কাউট, গার্লস গাইডসহ নানা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা, মানসিক স্বাস্থ্য ও নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বিশেষ কর্মসূচিও চালু হয়েছে। সুশিক্ষা নিশ্চিতে আশেপাশের ৫ গ্রামের অভিভাবকদের নিয়ে ৫৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে হোস্টেল নির্মাণেরও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এডহক কমিটির সভাপতি বলেন, “বিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবার সহযোগিতায় আশা করি তা সম্ভব হবে।”
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, “এডহক কমিটির উদ্যোগে হাতে নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে আশা করা যায় বিদ্যালয়টি আবারও শুধু উপজেলা নয়, জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”
প্রসঙ্গত, বিদ্যালয়ের সমস্যা উত্তরণে গত ১৪ আগস্ট সব অভিভাবক নিয়ে একটি সমাবেশ করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খান, দেবিদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামসুদ্দীন মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দেওয়ান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খান তার বক্তব্যে বলেন, “বিদ্যালয়ের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। সকলে একসাথে কাজ করলে মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে আবারও আগের গৌরবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
