ফ্যাসিবাদ: দর্শনের ভাষা থেকে রাজনীতির বাস্তবতা

 

মনোয়ার হোসেন রতন।।

আমরা কথায় কথায় কাউকে ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিবাদী বলে আখ্যায়িত করি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আসলে কী? এটি কেবল গালি নয়, বরং দর্শনের গভীর শিকড় থেকে উদ্ভূত এক রাজনৈতিক মতবাদ। আধুনিক রাজনৈতিক দর্শন ও ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ হলো এমন এক শক্তি, যেখানে রাষ্ট্রের সর্বময় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিসর্জিত হয়।

শব্দের উৎপত্তি ও দার্শনিক ভিত্তিঃ

ফ্যাসিবাদ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন “fasces” থেকে। রোমান সাম্রাজ্যে এটি ছিল লাঠির গুচ্ছ, যা একত্র বাঁধা অবস্থায় রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে এই প্রতীক থেকেই জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদের দার্শনিক ধারণা—একতা, শক্তি ও শৃঙ্খলার নামে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে দমন করা।

ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের প্রথম রাজনৈতিক রূপকার। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল: “Everything in the State, nothing outside the State, nothing against the State.” অর্থাৎ—রাষ্ট্রই সর্বকিছু, রাষ্ট্রের বাইরে কিছু নেই, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু নেই।

আরেক ইতালীয় দার্শনিক জিওভান্নি জেন্তিলে, যিনি ফ্যাসিবাদের “দার্শনিক জনক” নামে পরিচিত, তাঁর Actual Idealism দর্শনে বলেন—ব্যক্তি ও রাষ্ট্র অভিন্ন সত্তা। ব্যক্তির কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় নেই, রাষ্ট্রের মধ্যেই তার অস্তিত্ব।

ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক উদাহরণঃ

রাজনৈতিক বিজ্ঞানে ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এক ধরনের অতিজাতীয়তাবাদী, কর্তৃত্ববাদী ও সর্বগ্রাসী মতবাদ হিসেবে। এর কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক উদাহরণ হলো-

  • চরম জাতীয়তাবাদ ও সামরিকতাবাদ:
    নাৎসি জার্মানিতে হিটলার “আর্য জাতিকে শ্রেষ্ঠ” প্রমাণ করার জন্য ইহুদি নিধনযজ্ঞ চালান। জাতীয়তাবাদের নামে ছয় মিলিয়ন ইহুদির হত্যাযজ্ঞ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়।
  • ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রের প্রাধান্য:
    মুসোলিনির ইতালিতে নাগরিকদের কোনো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল না। সংবাদপত্র, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করত।
  • একনায়ক নেতৃত্ব:
    হিটলার জার্মানিতে, মুসোলিনি ইতালিতে, ফ্রাঙ্কো স্পেনে এবং পরবর্তীতে পিনোশে চিলিতে—একক নেতা জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করেন বলে প্রচার করা হতো।
  • সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থা:
    স্টালিনের রাশিয়াও এক ধরনের সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল, যদিও সেটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে প্রতিষ্ঠিত। মানুষের চিন্তা ও মতামতকে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
  • বিরোধী মতের দমন:
    হিটলারের গেস্টাপো হোক কিংবা মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্ট বাহিনী—ভিন্নমত দমনই ছিল ফ্যাসিবাদের প্রধান অস্ত্র।

হান্না আরেন্ড ফ্যাসিবাদকে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রব্যবস্থার (Totalitarianism) এক ধরন হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ফ্যাসিবাদ কেবল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি ও সমাজজীবন পর্যন্ত দখল করে নেয়।

অন্যদিকে, মার্ক্সবাদী চিন্তক অ্যান্টোনিও গ্রামশি বলেছেন—ফ্যাসিবাদ হলো পুঁজিবাদের সংকটকালে শাসকশ্রেণির প্রতিক্রিয়া। যখন জনগণের অসন্তোষ বাড়ে, তখন শাসকরা চরম শক্তি দিয়ে দমননীতি চালায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের ছায়াঃ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ফ্যাসিস্ট” শব্দটি প্রায়ই শোনা যায়। বিরোধীদল সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে, আবার সরকার বিরোধীদের ফ্যাসিস্ট বলে অভিযুক্ত করে। কিন্তু এখানে মূল সমস্যা হলো—শব্দটির দার্শনিক ও রাজনৈতিক গভীরতা আমরা প্রায়শই অগ্রাহ্য করি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কয়েকটি ঘটনা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়:

  • ১৯৭৫ সালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (বাকশাল)—যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছিল।
  • স্বৈরাচারী এরশাদ আমল, যখন রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন ও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
  • গণতন্ত্রোত্তর সময়েও দেখা গেছে—বিরোধী আন্দোলন দমন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বকে অতি গুরুত্ব দেওয়া।

সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণআন্দোলন। জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, রাজনৈতিক দমননীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকট এবং নির্বাচন নিয়ে অনাস্থা—সব মিলিয়ে দেশে এক প্রবল গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রক্ষমতা রক্ষায় সরকারের দমননীতি, গ্রেপ্তার-নিপীড়ন ও সহিংসতা ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আন্দোলনের জোয়ারে সরকার পতিত হয়।

এই ঘটনাই আবার প্রমাণ করে—গণতন্ত্রের শক্তি ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে চূর্ণ করতে পারে। রাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক, জনগণের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বরের কাছে তা টিকতে পারে না।

ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্রের দ্বন্দ্বঃ

ফ্যাসিবাদের বিপরীতে গণতন্ত্র ব্যক্তির স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ ও জবাবদিহিতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকে দেবতা বানায়, কিন্তু গণতন্ত্র রাষ্ট্রকে জনগণের সেবক হিসেবে দেখতে চায়। ইতিহাস প্রমাণ করে—

  • হিটলারের জার্মানি ১৯৪৫-এ ধ্বংস হয়েছে।
  • মুসোলিনির ইতালিও পতিত হয়েছে।
  • এরশাদের স্বৈরতন্ত্রও গণআন্দোলনের মুখে ভেঙে পড়েছে।
  • আর ২০২৪ সালের আন্দোলনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারও পতিত হয়েছে।

রাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক, মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে চিরকাল দমন করা যায় না।

ফ্যাসিবাদ কেবল একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়, এটি একটি ভয়ংকর বাস্তব অভিজ্ঞতা। এ কারণেই আমরা কথায় কথায় কাউকে ফ্যাসিস্ট বললেও আসল ফ্যাসিবাদের রূপ অনেক গভীর, অনেক ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শব্দ ব্যবহারের আগে আমাদের উচিত দর্শনের শেকড় ও ইতিহাসের শিক্ষা বুঝে নেওয়া।

রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান নয়, জনগণই সর্বশক্তিমান—এই সত্য ভুলে গেলে ফ্যাসিবাদ আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষাই ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের একমাত্র পথ।

inside post
আরো পড়ুন