জাতীয় কংগ্রেস নেতা : খ্যাতনামা আইনজীবী কামিনী কুমার দত্ত

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব।।

কামিনী কুমার দত্ত ১২৮৫ বঙ্গাব্দের ২৫ আষাঢ় জন্মগ্রহণ করেন। পরলোকগমন করেন ১৩৬৫ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ। কামিনী কুমার দত্তের আদিবাস শ্রীকাইল। এটি বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত হলেও একসময় বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার (চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ) অংশ ছিল। কুমিল্লার কৃতীসন্তানদের মধ্যে যারা জাতীয় কংগ্রেস করতেন তাদের অন্যতম কামিনী কুমার দত্ত। এ দলের অন্যান্য নেতারা হলেন ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, হেদায়েতুল্লাহ চৌধুরী, রমিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল মালেক প্রমুখ।

১৯২৩ সালে ডা. সুরেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কুমিল্লার আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সুধীজনদের সহায়তায় দেশিয় শিল্প, কৃষি শিক্ষা ও সংস্কৃতিসেবামূলক ও কল্যাণধর্মী কর্মকাণ্ড পরিচালনার মহানব্রত নিয়ে লাকসাম রোডে কুমিল্লা অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। কুমিল্লার প্রখ্যাত জননেতা ও উকিল অখিলচন্দ্র দত্ত, বিশে^ম্বর চট্টোপাধ্যায়, কামিনী কুমার দত্ত, দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও ইন্দুভূষণ দত্ত তাঁকে সহযোগিতা করেন।

১৯৩৮ সালে কিষাণ সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন কুমিল্লা টাউন হল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। ৪ মে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে সভাপতির করেন স্বামী সহজানন্দ। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন কামিনী কুমার দত্ত। এ সম্মেলনে নিখিল ভারত কিষাণ সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এন জি রঙ্গ কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আরও দুজন কিষাণ নেতা- ইন্দনাল সাত্ত্বিক ও বঙ্কিম চন্দ্র মুখার্জী এসেছিলেন। এ সভায় রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’ সঙ্গীত হিসেবে গীত হয়েছিল। যার বিষয়বস্তু ছিল মানুষের মুক্তি।

১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ এবং ২৬ চৈত্র জেলা ত্রিপুরার শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্র কুমিল্লায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দ্বাবিংশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাঁকজমকভাবে। কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ত্রিপুরা অধিপতি বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর। উদ্বোধনী পর্বে বন্দে মাতারম সঙ্গীত গীত হয়েছিল। ত্রিপুরার পূণ্যভূমি কুমিল্লায় আয়োজিত এ ঐতিহাসিক সাহিত্য সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বরেণ্য ভাষাচার্য ড. সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায়। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন কামিনী কুমার দত্ত ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ রাধাগোবিন্দ নাথ।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল তীব্র সম্প্রদায়িক বক্তৃতা দেন। এ বক্তৃতার পর পূর্ব বাংলার বিভিন্ন মহল ও এলাকায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। ১৪ জানুয়ারি কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণ-পাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের সদস্যবৃন্দ এক বিশেষ সাধারণ সভায় এ ভবন থেকে বঙ্কিম চন্দ্রের প্রতিকৃতি অপসারণের প্রস্তাব করেন এবং সেই প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ কার্যকর করা হয়। একই সাথে ‘আনন্দমঠ’ ও ‘রাজসিংহ’ উপন্যাস দুটিও পাঠাগার থেকে অপসারণ করা হয়। প্যাটেলের বক্তৃতার পর পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক পত্রিকাগুলো পূর্ব বাংলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে উত্তেজনাপূর্ণ মন্তব্য ও কাহিনী প্রকাশ করে। কুমিল্লায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিকৃতি অপসারণ সম্পর্কে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অপপ্রচার করে। এতে বলা হয়, চার শ’ মুসলমান হল আক্রমণ করে এবং মুসলমানের দুই শ’ হিন্দু পরিবারের বাড়ি লুণ্ঠন ও বিধ্বস্ত করে। এই মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ করেন কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা পাকিস্তান গণ পরিষদের সদস্য কামিনী কুমার দত্ত এবং পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের কংগ্রেস দলীয় উপনেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবৃতি প্রদান করেন। এ যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন জেলা মুসলিম লীগ সভাপতি আবিদুর রেজা চৌধুরী, বীরচন্দ্র গণ-পাঠাগার ও নগর মিলনায়তের সহ-সভাপতি জিতেন্দ্র লাল দত্ত, ত্রিপুরা সংখ্যা লঘু বোর্ডের সদস্য আশুতোষ সিংহ, কুমিল্লা মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান অতীন্দ্র মোহন রায়, মুসলিম লীগের সম্পাদক আজিজুর রহমান প্রমুখ। এছাড়া ত্রিপুরা সাংবাদিক সংঘের সভাপতি রজতনাথ নন্দী পৃথক বিবৃতিতে বলেন, ‘হিন্দুস্তানি বেতারে প্রচারিত এ সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ইহার ফলে শুধু উভয় দেশের পারস্পরিক সৌহার্দ্যই নষ্ট হইবে না, বরং পাকিস্তানে হিন্দুদের অবস্থাও সংকটাপন্ন হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে।’

১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু সম্মেলন কুমিল্লায় ঈশ^র পাঠশালায় অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সশস্ত্র নায়ক অনুশীলন দলের মহারাজ ত্রৈলোকানাথ চক্রবর্তী, কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদার, বরিশালের কমিউনিস্ট নেত্রী মনোরমা বসু মাসীমা প্রমুখ। সম্মেলনে আশুতোষ সিংহ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কামিনী কুমার দত্ত প্রমুখ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সম্মেলনে যুক্ত নির্বাচন ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে শক্তিশালী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

আগেই বলেছি, ১৯৩৮ সালের ১৪ মে কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন মতান্তরে কৃষাণ সম্মেলন। গবেষক মামুন সিদ্দিকী এ সম্মেলন প্রসঙ্গে তাঁর রচিত ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও বুদ্ধিভিত্তিক জাগরণ প্রেক্ষিত কুমিল্লা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন: ‘১৯৩৮-এ কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন। এমনি এক সভায় রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর গান গীত হয়েিিছল, যার বিষয়বস্তু ছিল মানুষের মুক্তি, যিনি ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’ কবিতা লিখে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, হেদায়তুল্লাহ চৌধুরী, আবদুল মালেক কংগ্রেসের সাথে জড়িত থাকলেও কৃষকের মুক্তি ছিল তাদের চিন্তার কেন্দ্র।’ (বাঙালির সংস্কৃতি সাধনা)।

এ সম্মেলন উপলক্ষ্যে গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন কামিনী কুমার দত্ত এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ আবুল কাশেম। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, লেখক আহসানুল কবীর রচিত ‘কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লেখক বলেছেন, ১৯৩৮ সালের ১৪ মে কুমিল্লা টাউন হল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় কিষাণ সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন। এ সম্মেলনে যোগ দেন নিখিল ভারত কিষাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এনজি রঙ্গ, কৃষক নেতা স্ত্রী ইন্দ্রনাল যাজ্ঞিক ও শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র মুখার্জী (পৃ. ২০০) অথচ এ গ্রন্থের ৪৯ পৃষ্ঠায় লেখক আহসানুল কবীর কিষাণ সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন উল্লেখ করেছেন এবং ১৪ মে এর স্থলে ৪ মে উল্লেখ করেছেন। তার এ লেখার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে এ সম্মেলন প্রকৃত পক্ষে কবে তথা কোন তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল? এটা কি কৃষক সম্মেলন নাকি কিষাণ সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন? এ সম্মেলনে যারা যোগদান করেছেন তাদের নামের বিভ্রান্তিও লক্ষণীয়। ৪৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন কিষাণ নেতা ইন্দলাল সাত্তি¦ক, ২০০ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন শ্রী ইন্দলাল যাজ্ঞিক- কোনটা সঠিক? বলা যায়, ওই সময় বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তনে কৃষকদের একটি সম্মেলন হয়েছিল এবং ওই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন কামিনী কুমার দত্ত।

বিচারপতি ব্যারিস্টার সৈয়দ আমিরুল ইসলাম জীবৎকালে ‘ঐতিহ্যে ভাস্কর কুমিল্লা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বৃটিশ আমল থেকে মফস্বল বারের মধ্যে কুমিল্লা বার লাইব্রেরি একটি অতিশয় প্রসিদ্ধ জেলা বার হিসেবে আইনজীবী ও অন্যান্য মহলে বেশ সমাদৃত ছিল। প্রয়াত কামিনী কুমার দত্ত যিনি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। প্রখ্যাত আইনজীবী ভোদর দাশ, অখিল চন্দ্র দত্ত (যার বাড়িতে বর্তমানে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড অবস্থিত) যিনি অবিভক্ত বাংলায় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন।’

১৯৬৫ সালের ১৩ জুন (১৩৭২ বঙ্গাব্দের ৩০ জ্যৈষ্ঠ) কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়া এলাকায় কামিনী কুমার দত্তের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দত্তের নামে মৃণালিনী দত্ত ছাত্রী নিবাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কামিনী কুমার দত্তের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দত্ত ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের ২৬ জ্যৈষ্ঠ পরলোকগমন করেন। কে কে দত্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে এ ছাত্রী নিবাসের কার্যক্রম চলছে। এ স্ট্রাস্টের সভাপতি ডিসি। এ ছাত্রী নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক গীতা সরকার বলেছেন, তার পিতা যতীন্দ্র চন্দ্র সরকার ছিলেন কামিনী কুমার দত্তের মুহুরী। ১৯৮৯ সালে যতীন্দ্র চন্দ্র সরকার পরলোকগমন করেন।

১ দশমিক ২ একর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত মৃণালিনী ছাত্রী নিবাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গীতা সরকার উপস্থিত ছিলেন। এ ছাত্রী নিবাসে থেকেই তিনি প্রথমে নিবেদিতা স্কুল ও পরে ঈশ^র পাঠশালা থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করেছেন। এরপর তিনি কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যয়ন করেন। তিনি ছাত্রী ইউনিয়নের সমর্থক ছিলেন এবং এ কলেজের অধ্যয়নকালে মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি তার বাবার কাছে শুনেছেন, বৃটিশ আমলে বিপ্লবীদের অনেকে এ ছাত্রী নিবাসে এসে আশ্রয় নিতেন এবং পুলিশ আসার আগে পালিয়ে যেতেন। এ ছাত্রী নিবাসের উত্তর পাশে বেস্টনি দেয়ালের নিচে একটি সুরঙ্গ পথ ছিল। পুলিশ এলে বিপ্লবীরা এ সুরঙ্গ পথ দিয়ে পালিয়ে যেতেন। কামিনী কুমার দত্তের পুত্রকন্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দু পুত্রের নাম জানেন। অজিত দত্ত ও সুজিত দত্ত। এ ছাত্র নিবাসে কামিনী কুমার দত্তের আত্মীয়-স্বজন আসেন কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, করোনার সময় কামিনী কুমার দত্তের ভাইয়ের স্ত্রী এসেছিলেন তাঁর নাম চারু মলিনী দত্ত।

এ বাড়িটি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক সমীর মজুমদার বলেন, একসময় কামিনী কুমার দত্তের এ বাড়িটি ব্যতীত এ এলাকায় তেমন কোনো বাড়ি-ঘর ছিল না। এ বাড়িতে বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া ছিল। আমি পল্লী কবি জসীম উদ্দীনকে এ বাড়িতে আসতে দেখেছি। কামিনী কুমার দত্ত খুব সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। সাদা ধবধবে ধূতি পরতেন। তাঁর ৪ পুত্র আছে বলে জানি কিন্তু কন্যা আছে কিনা জানিনা। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পরিমল দত্তের সাথে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। চট্টগ্রাম অস্রাগার লুণ্ঠনকারীদের অনেকে কামিনী কুমার দত্তের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তাদের আইনী সহায়তা ও টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করতেন। পরবর্তী সময় তাদেরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীকাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেন নরেন্দ্র নাথ দত্ত কামিনী কুমার দত্তের ছোট ভাই ছিলেন। ক্যাপ্টেন নরেন্দ্র নাথ দত্ত শ্রীকাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা।

কামিনী কুমার দত্ত সম্পর্কে শক্তিভূষণ মজুমদার বলেন, আমার বাবা অনাথ বন্ধু মজুমদারের সাথে কামিনী কুমার দত্তের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কামিনী বাবু আমার বাবাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বাবা ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। বাবার মুখে কামিনী কুমার দত্ত সম্পর্কে যা জেনেছি তা বলতে পারবো। আমি কামিনী কুমার দত্তকে দেখেছি কী দেখি নি, মনে নেই। বাবার মুখে শুনেছি, কামিনী কুমার দত্ত একজন দক্ষ আইনজীবী ছিলেন। সে-সময় ব্রুহি, বার্কি নামকরা আইনজীবী ছিলেন। তখন সুপ্রীম কোর্ট ছিল না। প্রিভি কাউন্সিল এর মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের কার্যক্রম চলতো। চুয়ান্ন সালের আগেই কামিনী কুমার দত্ত পাকিস্তান পার্লামেন্টের আইনমন্ত্রী ছিলেন। ওই কেবিনেটে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। কামিনী কুমার দত্তের বাল্যকাল খুব কষ্টে কটেছে। তাঁর বাড়ির পাশে রামচন্দ্রপুর বাজারে কোমড়ার ডগা বিক্রি করেছেন এমন গল্পও শোনা যায়। তিনি খালি পায়ে কলকাতা গিয়েছিলেন। এ কথাটি বাবার কাছে নরেন্দ্র নাথ দত্ত এমসিএ একদিন কথার ছলে বলেছিলেন। কলকাতা মেডিকেল হোস্টেলে থাকাকালে কামিনী কুমার দত্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। কামিনী কুমার দত্তের আর্থিক অনটনের কথা জেনে কলেজ অধ্যক্ষ তাকে হোস্টেলের যাবতীয় খরচ বহনের আশ^াস দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেন নি। তিনি অধ্যক্ষকে সরাসরি বলেন, আমি কারো দান গ্রহণ করবো না। আমাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। পরবর্তী সময় তিনি তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞায় বলীয়ান হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছেন। চিওড়ার মোশারফ হোসেন ছিলেন জলপাইগুড়ির নবাব। ‘নবাব’ শব্দটি ব্রিটিশ প্রদত্ত খেতাব। তিনি প্রচুর সয়-সম্পত্তি, টাকা-পয়সার মালিক ছিলেন। ভারতে তাঁর ২টি বাড়ি ছিল। একটি জলপাই গুড়িতে ‘জলপাইগুড়ি প্যালেস’ (রাজবাড়ি) অন্যটি কলকাতায় ‘জাহাজ বাড়ি’। জাহাজের আদলে তিনি এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর ৩২টি একক চা বাগান ছিল। তিনি ধার্মিক হলেও সেকুলার ছিলেন। ভারতবর্ষ বিভক্তির পর তিনি পাকিস্তানে (পূর্ব পাকিস্তান) আসতে চান নি। তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। এ মামলার আইনজীবী ছিলেন কামিনী কুমার দত্ত। মামলায় রায় তাঁর পক্ষে আসে। উল্লেখ্য, নবাব মোশারফ হোসেন ছিলেন কাজী জহিরুল কাইউমের আপন চাচা। ১৯৫০-এর দাঙ্গার সময় কাজী জহিরুল কাইউম জলপাইগুড়িতে তাঁর চাচার বাড়িতে ছিলেন।

কাজী জহিরুল কাইউম ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল কুমিল্লার চিওড়া থেকে আগরতলা পৌঁছেন। তিনি জীবৎকালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওখানে পৌঁছে কামিনী কুমার দত্তের জুনিয়র নৃপেন (নমেনও হতে পারেন) এর সাথে দেখা হয়। ইনি কুমিল্লায় কিছুদিন অবস্থান করেছেন। নৃপেন-এর একটি খালি বাড়ি ছিল। আমরা সেখানে গিয়ে উঠলাম’। এতেও বুঝা যায়, কামিনী কুমার দত্তের সাথেই শুধু নয় তাঁর নিকটস্থ বা অধীনস্থ অনেকের সাথে কাজী জহিরুল কাইউমের যোগাযোগ ছিল। আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের কাজ মোটামুটি গুছিয়ে কাজী জহিরুল কাইউম সোজা চলে যান জলপাইগুড়িতে তাঁর চাচা নবাব মোশারফ হোসেনের বাসায়। আমার পিতা মনিরুল ইসলাম সরদারও একসময় জলপাইগুড়িতে নবাব মোশারফ হোসেনের একটি চা বাগানে চাকরি করতেন। তাঁর কাছে নবাব মোশারফ হোসেনের অনেক গল্প শুনেছি। এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। ওদিকে যাবো না। প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী প্রেমাশীষ চৌধুরী বলেছেন, নবাব মোশারফ হোসেনের বড় ভাই ছিলেন কাজী জুলফিকার হোসেন। শক্তিভূষণ মজুমদার বলেছেন, কামিনী কুমার দত্তের সাথে খান বাহাদুর ছিদ্দিকুর রহমানের সুসম্পর্ক ছিল। তখন হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কামিনী কুমার দত্তের কনিষ্ঠ পুত্র অজিত কুমার দত্ত এ্যাটর্নী জেনারেল ছিলেন। তিনি আরও বলেন, কামিনী দত্তের ছোট ভাই ক্যাপ্টেন নরেন্দ্র দত্তের একটি ঘোড়ার ফার্ম ছিল কলকাতায়। তিনি ব্যাচেলর ছিলেন। তিনি কেন আত্মহত্যা করেছিলেন তা জানি না বা জানা যায় নি। কামিনী কুমার দত্ত সম্পর্কে এ নিবন্ধ লিখার আগে তথ্য সংকটে পড়েছি। এ অবস্থায় কান্তি দা’র (খাদি ঘর-এর সত্ত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা) কাছে গেলে তিনি অনেক ভেবেচিন্তে বলেন, পথে নামলে পথই পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বলেন, কামিনী কুমার দত্ত সম্পর্কে শক্তি দা অনেক কিছু জানেন। তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ফোনে যোগাযোগ করলেন এবং আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেন। শক্তি দা (শক্তিভূষণ মজুমদার) মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। তাঁকে ও কান্তি দা’কে কৃতজ্ঞতা জানাই।

কামিনী কুমার দত্ত অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে অসীম ধৈর্য্য, মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে জীবনের উন্নতি ঘটিয়েছেন। খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী হিসেবে সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তাঁর আদর্শকে ধারণ ও লালন করা প্রয়োজন দেশের রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীদের।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।