‘জিনিসপত্রের দাম শুইনে মাথা ঘুইরে যায়’
ইলিয়াস হোসাইন।।
পঞ্চাশোর্র্ধ্ব মো. হাবিল মিয়া। ২০১৩ সাল থেকে এবি ব্যাংকের মোগলটুলী শাখার বুথ সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে নিয়োজিত আছেন। স্ত্রীকে নিয়ে কাপ্তান বাজার এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
মাস শেষে বেতন পান ৭৫০০টাকা। বাসা ভাড়া দেন ৩হাজার টাকা। বাকি টাকায় সংসার খরচ,স্ত্রীর ঔষধপত্রসহ নিজের খরচ। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কথা কে ভাবে? খেয়ে-না খেয়ে পড়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নেয় না। জিনিস পত্রের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে,কিন্তু বেতনতো আর বাড়ছেনা! এ অল্প টাকার বেতন দিয়ে কি আর সংসার চলে? মাস শেষে হতাশা আর ঋণের বোঝাই বইতে হয়।
এ ব্যাংকের উত্তরপাশের গলিতে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে জুতা সেলাই করছেন গাংচর ঋষি পট্টির স্থানীয় দিনাঋষি দাস(দিনবন্ধু)। তিনি বলেন,রোজগার আগের চেয়েও কইমা গেছে। ২’শ টাকা কামাইতেও বহুত কঠিন হইয়া যায়। সবকিছুর দাম দুইগুণ বাইড়া গেছে। এই টাকা দিয়া মাইয়া-পোলার পড়া-লেহার খরচ,তাগো খাবার-দাবার জোগান কঠিন হইয়া যাইতাছে!
রংপুর কুড়িগ্রাম থেকে আসা রিক্সা চালক নবীর উদ্দিন। কুমিল্লা নগরীর ঢুলি পাড়ায় ভাড়া থাকেন। রিক্সার মালিককে ভাড়া বুঝিয়ে নিজের থাকে দৈনিক ২০০-২৫০টাকা। মাসে ৬-৭হাজার টাকা উপার্জন করেন। এর থেকেই মাস শেষে বাসা ভাড়া গুনতে হয় ২৫০০টাকা। স্ত্রীসহ এক ছেলে-এক মেয়ের সংসার। ভারাক্রান্ত স্বওে তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম শুইনে মাথা ঘুইরে যায়,ভাই! রাইতে চিন্তায় ঘুম হয় না! তরকারি থেকে শুরু করে দিন দিন সবকিছুর দাম বাইড়েই চলছে। আমাগো রিক্সা ভাড়াতো আর বাড়ে না। বাড়িতে কয় টাকা পাঠাইবো,নিজে কি খাইবো,চিন্তা কইরলে তা মাথা ধইরে না,ভাই। আসলে এই দেশে গরিব মাইনষের সুখ নাই।
তিনি বলেন, নগরীতে রংপুর অঞ্চল থেকে আসা প্রায় তিন হাজারের বেশি রিক্সা চালক আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়,নগরীর রাজগঞ্জ,চকবাজার,নিউমার্কেট,টমছমব্রিজ,ইয়াছিন মার্কেট(আশ্রাফপুর),বাদশামিয়ার বাজার,রাণীর বাজারের দৈনিক মূল্যচিত্র। তাল বেগুন-৮০টাকা,লম্বা বেগুন ৬০টাকা,ফুলকপি প্রতিটি ৫০-৬০টাকা,বাধা কপি প্রতিটি ৩০টাকা,সিম ৬০টাকা,ডায়মন্ড আলু ২০টাকা,টমেটো ৪০টাকা, মিষ্টি কুমড়া-৪০-৮০টাকা,গাজর ৫০টাকা।
সূত্র জানায়, মাছের-মুরগির খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে মাছ-মুরগির বাজারের মূল্যচিত্রও পাল্টে গেছে। বর্তমানে ১কেজি পরিমাণের রুই মাছ ২৩০-২৫০টাকা,বড় রুই ২৮০-৩০০টাকা দরে,কাতল ২৫০-৩০০,বড় তেলাপিয়া ১৮০-২০০টাকা, ছোট তেলাপিয়া ১৫০টাকা, পাঙ্গাস ১৫০-১৬০টাকা,২৫০টাকা দরের সামুদ্রিক টুনা বর্তমানে ৪০০-৪৫০কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ভোজ্যপণ্য তেল এই সপ্তাহে বেড়ে ১৭৫টাকা,মোটা মসুর ডাল ১০টাকা বেড়ে ১০০টাকা,বুটের ডাল(মোটর) ১০টাকা বেড়ে ৫৫টাকা। চনা বুটের ডাল ৮০টাকা,পেঁয়াজ ১৫টাকা বৃদ্ধিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৫টাকা দরে।
প্রতি ডজন মুরগির ডিম ১১০টাকা -১ হালি ৪০টাকা,ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৫০টাকা,সোনালি মুরগির দাম বেড়ে ২৯০টাকা,কক মুরগি ২৫০টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত চওড়াই হচ্ছে। নিচের দিকে নামছে না দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগামী সূচক। এতে অতিমাত্রার প্রভাব পড়ছে নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের উপর।
টিক্কাচরের বাসিন্দা সবজি বিক্রেতা মনির হোসেন জানান,যে দরে তিনি সবজি কিনেন প্রতি সবজিতে তিনি ৫-১০টাকা লাভে বিক্রি করে থাকেন। সবজির দাম চওড়া থাকায় বেচা-বিক্রি কমে গেছে। একজন কর্মচারীর দৈনিক ৫০০টাকা বেতন, দোকানভাড়া ভাড়া দৈনিক ৫’শ টাকা দিয়ে দিন শেষে লাভ থাকেনা। কুমিল্লার নিমসার এবং ঢাকা কারওয়ান বাজার থেকে মাল সংগ্রহ করি। মালের দাম অনেক বাড়া।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, বড় বড় পাইকাররাএর জন্য দায়ী। তারা কৃষকদের থেকে খুব কম টাকায় মাল জব্দ করেন। খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট তারা বেশি টাকায় মাল সরবরাহ করেন। এতে পাইকাররাই লাভবান হয়। আর মাঝখানে কৃষক,খুচরা ব্যবসায়ী এবং সাধারণ ভোক্তারাই নিত্য ঠকছে।
মনোহরগঞ্জের তরুণ ফেরিওয়ালা নুরুন্নবী। নগরীর কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভ্যানে করে পুরাতন কাপড় বিক্রি করেন। ব্যবসায় তিনি একেবারেই নতুন। তার নিয়মিত খরিদ্দার নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা। প্রতিদিন ৮শ-১হাজার টাকা বিক্রি করতে পারেন। সবখরচ বাদ দিয়ে ২’শ-৩’শ টাকা থাকে। মা-স্ত্রী,দু’মাসের মেয়েসহ কুমিল্লার বউ বাজার এলাকায় ভাড়া থাকেন। তিনি বলেন,বউয়ের এখন পুষ্টিকর খাবার দরকার,সিজার হয়েছে দু’মাস হলো।পুষ্টিকর খাবার কি দেব,খাবার দাবারের যা দাম! দেখা যাবে না খেয়েই আমাদের এখন দিন কাটাতে হবে।
আনারস বিক্রেতা জামাল মিয়া। প্রতিদিন রেলস্টেশন থেকে চকবাজার পর্যন্ত ভ্যানে করে আনারস বিক্রি করেন। প্রতিটি আনারস ৪০-৫০টাকা দরে বিক্রি করেন। দু’দিনে ২০০ আনারস বিক্রি করতে পারলে লাভ হবে ১হাজার টাকা। দৈনিক ৪’শ -৪৫০টাকা আয় করেন। নগরীর শাসনগাছা রেলস্টেশনের পাশে ভাড়া থাকেন। বাড়ি নরসিংদীর বেলভোরে। দুই সন্তানসহ ৪জনের পরিবার। ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে,মেয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করে। তিনি জানান,এই স্বল্প উপার্জনের টাকায় সন্তানদের পড়ালেখার খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতে খুব কঠিন হয়ে যায়। ইচ্ছে করলেও সন্তানকে মাছ-মাংস খাওয়াতে পারিনা। আগে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারলেও বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মাস শেষে তার ঘাটতি থেকে যায়।
নরংসিংদী,সুনামগঞ্জ,ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা প্রায় ভ্রাম্যমাণ ৩’শ-৩৫০জন ব্যবসায়ী আছেন। তারা সবাই নগরীর চকবাজার,কান্দিরপাড়,রাজাগঞ্জ,শাসনগাছা রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন এলাকায়, মোড়ে বসে কলা,আনারস,পেঁপে, বরইসহ বিভিন্ন দেশীয় ফল ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে বিক্রি করেন। তাদের জীবনযাত্রার মানও জামাল মিয়ার মতই অসহনীয়।