ডাকসু: ইতিহাস, সংগ্রাম ও বর্তমান বাস্তবতা

 

মনোয়ার হোসেন রতন।।

বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পেরিয়ে আসা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল একাডেমিক জ্ঞানের ক্ষেত্র নয়, বরং জাতির রাজনৈতিক চেতনায়, আন্দোলনে এবং নেতৃত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর এই ভূমিকার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)

ডাকসুকে প্রায়শই বলা হয় “বাংলাদেশের মিনিপার্লামেন্ট”। কারণ, এখান থেকেই উঠে এসেছেন বহু জাতীয় নেতা, যাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হয়েছে। ডাকসুর ইতিহাসকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে আলাদা করে দেখা যায় না—এই সত্য আজ ইতিহাসবিদদের কাছেও অনস্বীকার্য।

প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক কাঠামো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। শুরুর দিক থেকেই ছাত্ররা সংগঠিতভাবে তাদের একাডেমিক, সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। ১৯২৩–২৪ শিক্ষাবর্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ”। ১৯২৫ সালে প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। পরে ১৯৫৩ সালে নামকরণ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)

ব্রিটিশ আমল থেকেই ছাত্ররা রাজনৈতিক চেতনার সাথে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত ছিল। পাকিস্তান আমলে এসে এই সাংগঠনিক শক্তি আরও বলিষ্ঠ হয়। বিশেষত ১৯৫০–এর দশক থেকে ডাকসু ছাত্র আন্দোলনের প্রধান প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।

ভাষা আন্দোলনে ডাকসুর ভূমিকা

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এবং ডাকসু নেতৃত্ব তখন থেকেই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ মিনার নির্মাণ ও ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ডাকসু নেতাদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। রফিক, বরকত, সালাম, জব্বাররা যখন রক্ত দিলেন, তখন ডাকসু নেতারা সামনে থেকে সংগ্রাম সংগঠিত করেছেন।

এই আন্দোলন শুধু ভাষার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং স্বাধীনতার আন্দোলনের বীজ বপন করেছিল।

স্বাধীনতা আন্দোলন ও ডাকসু

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ডাকসু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর অসংখ্য নেতা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, কেউ সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ডাকসু তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা।

স্বাধীনতার পর ডাকসু

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ভিপি হন আব্দুর রব এবং জিএস হন আবদুল কুদ্দুস মাখন। তারা মুক্তিযুদ্ধোত্তর ছাত্রসমাজ পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

পরে বিভিন্ন সময়ে ডাকসুতে নেতৃত্ব দেন ভিন্ন ভিন্ন ধারার নেতারা—

  • ১৯৭৯: ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (ছাত্র ইউনিয়ন)
  • ১৯৮০: ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না
  • ১৯৯০–৯১: ভিপি আমানুল্লাহ আমান ও জিএস খায়রুল কবির খোকন (ছাত্রদল)

তারা প্রত্যেকেই জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

দীর্ঘ বিরতি ও ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন

১৯৯১ সালের পর টানা ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল। অবশেষে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

  • ভিপি নির্বাচিত হন নুরুল হক নুর (স্বতন্ত্র/কোটা আন্দোলনের নেতা)
  • জিএস নির্বাচিত হন গোলাম রাব্বানী (ছাত্রলীগ)

যদিও এই নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, তবুও ২৮ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন সূচনা ঘটেছিল।

২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন

দীর্ঘ ছয় বছর পর আবারও ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে।

সময়সূচি (২০২৫):

  • খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ: ৩০ জুলাই
  • আপত্তি দাখিলের শেষ সময়: ৬ আগস্ট
  • চূড়ান্ত ভোটার তালিকা: ১১ আগস্ট
  • মনোনয়ন ফরম বিতরণ: ১২–১৮ আগস্ট
  • মনোনয়ন জমা: ১৯ আগস্ট
  • যাচাই: ২০ আগস্ট
  • প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা: ২১ আগস্ট
  • প্রত্যাহারের শেষ সময়: ২৫ আগস্ট
  • চূড়ান্ত তালিকা: ২৬ আগস্ট

বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  • মোট ২৮টি কেন্দ্রীয় পদে ভোট হবে।
  • আবাসিক হল থেকেও প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন।
  • প্রায় ৫০০–৬০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
  • প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসের বাইরে নির্ধারিত ৬টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে।
  • প্রচারণায় কঠোর বিধিনিষেধ: কোনো মিছিল নয়, সর্বোচ্চ ৫ জন সমর্থক নিয়ে মনোনয়ন জমা।
  • ভোটারদের জন্য খাবার, উপহার, পরিবহন সুবিধা নিষিদ্ধ; লঙ্ঘন করলে ২০,০০০ টাকা জরিমানা ও শাস্তির বিধান আছে।
  • এবারের প্রার্থীরাঃ

ডাকসুর আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ৯টি প্যানেল—ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্র শিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, বামপন্থী সংগঠন, স্বতন্ত্র এবং আঞ্চলিক সংগঠন।

ভিপি পদে আলোচিত প্রার্থীরা:

  • সাদিক কায়েম (ইসলামী ছাত্র শিবির)
  • আব্দুল কাদের (সাবেক শিবির, নতুন ধারা)
  • আবিদুল ইসলাম (সাবেক শিবির, ছাত্রদল ঘনিষ্ঠ)
  • ছাত্রলীগ, বাম প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।
  • ডাকসুর বর্তমান গুরুত্বঃ

আজকের দিনে প্রশ্ন উঠছে—ডাকসু কি তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছে? স্বাধীনতার আন্দোলন, গণতন্ত্রের সংগ্রাম, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ডাকসুর নেতৃত্ব ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু দীর্ঘ বিরতি, অনিয়ম এবং ছাত্র রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতার কারণে ডাকসুর প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কিছুটা কমে গেছে।

তবে আশার কথা হলো—২০২৫ সালের এই নির্বাচন ছাত্রসমাজকে নতুন করে রাজনৈতিক চর্চা, গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব এবং সচেতনতার পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।

ডাকসুর ইতিহাস আমাদের শেখায়, ছাত্রসমাজ কেবল দর্শক নয়, তারা জাতির চালিকাশক্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা, শিক্ষা আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক চর্চা—সবখানেই ডাকসু নেতৃত্ব দিয়েছে।

আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে ডাকসু কেবল অতীতের গৌরবগাথা নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। যদি নির্বাচন স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়—তাহলে এই মঞ্চ থেকে আবারও জাতীয় নেতৃত্ব উঠে আসবে, যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তাই শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং জাতির রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক।

inside post
আরো পড়ুন