তোরা সব জয় ধ্বনি কর– মনোয়ার হোসেন রতন

 

 

দীর্ঘ অপেক্ষা,আকাঙ্খা এবং প্রতীক্ষার মধ্য দিয়ে অবশেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। দেশের প্রায় দেড় লাখের বেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী প্রায় চার কোটি। কোটি প্রাণের আনন্দে মুখরিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আজ তোরা সব জয় ধ্বনি কর। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এ কারণেই বৈশ্বয়িক মহামারির সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল প্রায় দেড় বছর। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের উনিশ দফা নির্দেশনা মেনেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এস এস সি ও এইচ এস সি পরীক্ষার্থী এবং প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে, অন্য শ্রেণী গুলোর শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে এক দিন ক্লাসে যেতে হবে, যেদিন যে শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাবে, সেদিন দুটি করে ক্লাস। আমরা আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁর সকল কার্যক্রমে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।

ছাত্রদের প্রধানতম কর্তব্য অধ্যয়ন বা লেখাপড়া তারা অব্যাহত রাখবে। সংস্কৃত ভাষায় প্রবাদ আছে, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ সকলেই একাগ্রভাবে তা মেনে চলবে। বিশ্বময় মহামারীকালীন এ সময়ে যে ক্ষতি সর্বস্তরে হয়েছে তা আমরা শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা এবং সকল প্রকার আচরণবিধি মেনে শ্রম সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো। স্টিভ এরিকসনের কথা, ইতিহাসের অন্যতম শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে মানুষ সাধারণত শিক্ষা নেয় না, এর পরিণতি যত অনাকাঙ্খিত এবং মূল্য যত উচ্চই হোক, এ কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেবে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম। করোনাকালীন যে বিপর্যয় নেমে এসেছে সর্বস্তরে, বিশেষ করে জাতির মেরুদণ্ডে। সুতরাং শিক্ষার্থীরা স্মরণ রাখবে, স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রস এর অধ্যবসায়ের গল্পটি। যিনি কিনা ইংরেজদের সঙ্গে পর পর ছ’বার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও দমে যাননি। সামান্য একটা মাকড়সা বারবার একটি স্তম্ভের উপরে উঠার চেষ্টা করছে। এ অদম্য প্রচেষ্টা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে রবার্ট ব্রস নতুন উদ্যমে সৈন্য সংগ্রহ করে শত্রুকে পরাজিত করে সপ্তম বারে ইংরেজদের পরাজিত করে স্বদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। দুর্গম পর্বত শিখরে জয়ের নিশান রেখে সম্রাট নেপোলিয়ান বলতেন, অসম্ভব’ শব্দটি শুধুই নির্বোধের। গত প্রায় দেড় বছরে যে ক্ষতি ছাত্ররা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, সেই অসম্ভব ক্ষতি তারা পূরণ করে নেবে। জীবনের লক্ষ্যকে ঠিক রেখে, আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, আবেগ এর সাথে একাগ্র শ্রম, নিষ্ঠা, সাধনার মধ্য দিয়ে প্রত্যেককেই তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিভা বলে কিছু নেই। পরিশ্রম আর সাধনাই হচ্ছে আসল কথা। মহাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যে সময় যাচ্ছে, এ সময় প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের কিছু দায়বদ্ধতার ব্যাপার রয়েছে। স্বজন, প্রিয়জন হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে যাওয়া সময়টা, বেশ অগ্নিপরীক্ষার। সুতরাং ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সকলের প্রতি সকলেই যত্নবান এবং সহনশীলতার মাঝে থেকে শান্তচিত্তে এ ভয়াবহ প্রতিকূলতাকে ধৈর্যধারণের সংগে মোকাবেলা করে কাঙ্খিত সাফল্য বের করে আনবে। শিশু, কিশোর, তরুণ, ছাত্র ছাত্রীদের বন্দিজীবনের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, কান্নার ধ্বনি শুনে, তাদের অব্যক্ত গুমড়েমরা কথামালার ধ্বনির আওয়াজ আমাদেরকে বুঝতে হবে।এরই মধ্যদিয়ে করণীয় ঠিক করে এগুতে হবে।

এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান। শিক্ষকরাই হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এ কঠিন সময়ে তাঁদের সাহচার্য, নির্দেশনা এবং তত্ত্বাবধানে ভেংগে পড়া শিক্ষা জীবনে নিয়ে আসতে পারে গতি। শিক্ষার্থীর কাছে
শিক্ষক হচ্ছেন, ঋজওঊঘউ, চঐওখঙঝঙচঐঊজ অঘউ এটওউঊ. সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যদিয়ে বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে আনতে সমষ্টিগতভাবে শিক্ষক সম্প্রদায়ের ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ণ। উদ্ভাসিত সত্য সুন্দর জ্ঞানের আলো জ্বালানো শিক্ষকের প্রধান কাজ, চিরন্তন এ সত্যকে মেনে ও মনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি বড় ভূমিকা পালনের এখনই সময়। বিগত দিনের সকল ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য কঠিন অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। অভিভাবক শ্রেণী এবং শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ সময় চরম ও পরম সহিঞ্চুতার পরিচয় দিতে হবে। শোক ও দুঃখের মধ্য দিয়ে যে সময় অতিবাহিত হচ্ছে, এ সময়ে সকলের জীবনে নেমে এসেছে প্রচুর বাধা, বিঘ্ন। প্রতিজন মানুষ এক একটি সময় পার করেছে চরম অগ্নি পরিক্ষার মধ্য দিয়ে। বেঁচে থাকাটাই যেন হয়ে উঠেছে উৎসব। চারদিক ছিলো অমানিশার অন্ধকার, মৃত্যুর মিছিল। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সকলের সহিঞ্চু আচরণই দিতে পারে এক মহাশক্তি। যে শক্তির উপর দাঁড়িয়ে গোটা দেশের শিক্ষাজীবন আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবে। বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসে মহামারির বিপদ মোকাবেলা করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে সুখের বন্দরে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যবিধির যে কথা বলা হয়েছে, তা প্রত্যেককে মেনে চলা আবশ্যক। বাস্তবতা যত কঠিন হোক, বাস্তব বিশ্লেষণের মধ্যদিয়েই তা মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিজন শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনার বীজ। নীতি নির্ধারকগণকে স্মরণ রাখতে হবে, ছাত্রজীবন হলো দায়িত্ববোধের কাল, এ কালপর্বে সামাজিক কর্তব্যবোধে দীক্ষিত হবার এ সময়ে তাঁদের জন্য সুচিন্তিত, সঠিক পদক্ষেপ নিতে আর যেন কোনো ধরনের শংকার মধ্যে তাদেরকে পড়তে না হয়। নৈরাশ্যের অন্ধকার আসবে কিন্তু তাদেরকে আশাবাদী মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলতে হবে। আমরা সবাই ছোটবেলার এ গল্পটি সম্পর্কে জানি, এক বৃদ্ধের কয়েকজন পুত্র ছিল। তার পুত্রদের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ছিলো না। তারা সব সময় পারস্পরিক ঝগড়া কলহে মত্ত থাকত। এ জন্য একদিন বৃদ্ধ তার পুত্রদের ডেকে নিয়ে প্রত্যেকের হাতে একটি করে পাটকাঠি ভাংতে দিল। পুত্ররা সহজেই সেই পাঠকাঠি ভেংগে ফেলতে পারল। কিন্তু এবার বৃদ্ধ সবগুলো পাঠকাঠি একত্রে একটি আঁটি বেঁধে তাদেরকে ভাংগার নির্দেশ দিল, কিন্তু এভাবে তারা কেউ সফল হলো না, বৃদ্ধ এই দৃষ্টান্তের সাহায্যে তার পুত্রদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘দেখ বৎসগণ, এরুপ যতদিন তোমরা সবাই একত্র হয়ে সদ্ভাবে অবস্থান করবে, ততদিন কেউ-ই তোমাদের কোনরুপ অনিষ্ট করতে পারবে না। কিন্তু পরস্পর বিবাদ করে পৃথক থাকলে অন্য লোকে সহজেই তোমাদের ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হবে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের গতিধারা অব্যাহত রাখতে হলে, পারস্পরিক মতভেদ, বিবাদ ভুলে সকলকেই একসাথে কাজ করে সকল ক্ষতিকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে পারলেই আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবো। আসন্ন তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যে ছাত্র সমাজ স্টিয়ারিংএ বসবে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে না পারলে জাতির দুর্ভাগ্যের অন্ত থাকবে না। স্মরণ রাখতে হবে, মানব জীবনে বড় সম্পদ হচ্ছে সময়।