দইয়ের পাতিলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিজয়পুরের মাটি শিল্প

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
কুমিল্লা বিজয়পুরের মৃৎশিল্প। ডুবতে বসা শিল্পটি দইয়ের পাতিলের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে ২০লাখ টাকার বেশি পাতিল। যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এদিকে শিল্পীদের দাবি গ্যাস সংকটে পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারছেন না। গ্যাস দিয়ে পোড়ানো পণ্যের মান ভালো হয়, খরচ ও নষ্ট কম হয়।


স্থানীয় সূত্রমতে, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য শত বছরের। বিজয়পুর এলাকার সাতটি গ্রামের সাত শতাধিক পাল সম্প্রদায় পরিবারের মানুষ মাটির হাড়ি পাতিল তৈরি করতেন। গ্রাম গুলো হচ্ছে গাংকুল, তেগুরিয়াপাড়া,দক্ষিণ বিজয়পুর, বারপাড়া, দুর্গাপুর, উত্তর বিজয়পুর ও নোয়াপাড়া। ৬০এর দশকে অ্যালুমিনিয়াম আসায় মাটির পাতিলের চাহিদা কমে যায়। সমবায় আন্দোলনের পথিকৃত ড. আখতার হামিদ খান ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল ১৫ জন যুবককে নিয়ে গড়ে তোলেন বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। এ সমিতির মাধ্যমে মৃৎশিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। হাড়ি পাতিল,বল-বাটি,মগ-জগ থেকে বের হয়ে তারা নান্দনিক সব শো-পিস তৈরি শুরু করেন। এগুলোরও চাহিদা থাকলেও বিক্রি হয় ধীরগতিতে। এরপর গ্যাস সংকটে সামগ্রীর মান ভালো না হওয়ায় বিদেশিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এরপর কারিগররা নেমে পড়েন দইয়ের পাতিল,দইয়ের কাপ ও চায়ের ভাড় তৈরিতে। বর্তমানে এগুলোর ভালো চাহিদা রয়েছে। বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামে আরো ১২টি কারখানা গড়ে উঠেছে। তাদের অধিকাংশ দইয়ের পাতিল তৈরি করছেন। কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে ৫শতাধিক মৃৎ শিল্পী ও শ্রমিকের। কুমিল্লার মাতৃভান্ডার,ভগবতী পেড়া ভান্ডারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পাতিল ব্যবহার করছেন।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়,৫০জনের মতো কর্মচারী দইয়ের এক কেজি,আধা কেজি,আড়াইশ’ গ্রাম, একশ’ গ্রামের পাতিল ও কাপ তৈরি করছেন। কেউ কাঁচা মাটি ছাঁচে ফেলছেন। কেউ এগুলো পুড়ছেন। কেউবা নকশা করছেন। ছোট কাপ গুলো যাবে মালেয়শিয়া। এখানে মাসে ৪০হাজার পাতিল তৈরি হচ্ছে। সব কারখানা মিলিয়ে মোট লাখের ওপরে পাতিল তৈরি হচ্ছে।


কারাখানার প্রবীণ শিল্পী নিমাই চন্দ্র পাল বলেন,তার বাড়ি পাশের গাংকূল গ্রামে। তিনি ৪০বছর ধরে কাজ করেন। গ্যাস না থাকায় সমস্যা হচ্ছে, বিশেষ করে বিদেশে পণ্যের চাহিদা কমেছে।
রিংকু রাণী পাল বলেন,তিনি ১০ বছর ধরে কাজ করেন। এখানে পুরুষের সাথে ৩০জনের মতো নারীও কাজ করেন। গ্যাসের চাপ বাড়লে তাদের উৎপাদন বাড়বে। দ্বিগুণ শ্রমিকের কাজের সুযোগ হবে।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস কুমার পাল বলেন, দইয়ের পাতিলের ভালো চাহিদা রয়েছে। দইয়ের পাতিলের হাত ধরে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে গ্যাস সংকটে পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারছেন না। গ্যাস দিয়ে পোড়ানো পণ্যের মান ভালো হয়, খরচ কম, নষ্টও কম হয়। ১৯৯১সালে গ্যাস সংযোগ পান। বেলতলী থেকে লাইনটি পাঁচ কিলোমিটার পার হয়ে বিজয়পুর আসে। সেই লাইনে আবাসিক ও অবৈধ লাইন সংযুক্ত হওয়ায় ২০১৫ সালে চাপ কমে যায়। ২০১৭সালে গ্যাসের চাপ শূন্য হয়ে যায়। এনিয়ে তারা সমবায় অধিদপ্তর ও বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে দৌড় ঝাঁপ করছেন। ছয় বছরেও কোন সমাধান হয়নি।
সদর দক্ষিণ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া খানম বলেন,বিজয়পুর মৃৎশিল্প কুমিল্লার ঐতিহ্য। এখানে গ্যাসের চাপ কম থাকার বিষয়টি আমরা খবর নিয়ে দেখবো। তাদের এই সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলবো।
বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম কোম্পানি লিমিটেডের ডিজিএম (সেলস) প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক বলেন, রেললাইনের নিচ দিয়ে সংযোগ নিতে তাদের রেলের অনুমতি নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া তাদের একটি ডিমান্ড নোট দেয়া হয়েছে। এসব শর্ত পূরণ হলে নতুন সংযোগ দেয়া হবে।