নিম্মবিত্তের নিকট ‘গরুর মাংস এখন বড় লোকের খাবার!’

মোহাম্মদ শরীফ।।
উর্ধগতির নিত্যপণ্যের বাজারে গরুর মাংস ক্রয় যেন নিম্ম আয়ের মানুষের জন্য বিলাসিতা। নগরীর বাজারে হাড্ডিসহ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকা ধরে। হাড্ডি ছাড়া প্রতি কেজি নিতে হচ্ছে ৮০০ টাকায়। টমছম ব্রিজ কাঁচা বাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা নজরুল ইসলাম জানান, নিত্যপণ্যের সাথে গরুর মাংসের দামও বেড়ে গেছে। নিম্ম আয়ের মানুষ খুব কমই আসে তার দোকানে। মাঝে মধ্যে ২৫০ গ্রাম মাংস কিনতেও কিছু ক্রেতা আসেন। তিনি বুকে হাত দিয়ে বলেন, ‘সবার মনেই তো চায় একটু ভালা খেতে। ওদের কাছে ২৫০ গ্রাম মাংসও বিক্রি করি।’ কুমিল্লা নগরীর হকার, রিক্সা চালক ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হয়। তাদের কাছে একটি প্রশ্ন ছিল- শেষ কবে গরুর মাংসের খেয়েছিলেন।
কুমিল্লা নগরীত কুলফি আইসক্রিম বিক্রি করেন মাসুদ মোল্লা (৪৪)। জীবিকার তাগিদে কুষ্টিয়া থেকে কুমিল্লা এসেছেন তিনি। দুই মেয়ে এক ছেলে, স্ত্রী ও মা বাবা নিয়ে তার সংসার। থাকেন নগরীর রেইসকোর্সে। নিত্যপণ্যের উর্ধগতির জীবনে কেমন আছেন মাসুদ মোল্লা?

জানালেন, ‘আগে কিছুটা ভাল চলতে পারতাম। এখন জীবন কোন রকম যাচ্ছে। সব দিকের খরচ যোগান দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে সংসার।’
ভ্রাম্যমাণ এই হকার বলেন, ভালা খামু কি ভাই, পেট ভরে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাটাও কখনো কখনো কষ্ট হয়ে যায়। ছেলেকে সুন্নতে খাৎনা করিয়েছিলেন চার মাস আগে। ঐ সময় দুই কেজি গরু মাংস কিনে দোয়া পড়াইছিলাম। এখন তো দুই কেজি মাংস কিনলে ব্যবসার পুঁজি শেষ হয়ে যাবে।’

নগরীর টাউন হল গেইটে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করেন লাকসামের মো. মহিন (৪০)। জীবন কেমন চলছে ? প্রশ্ন শুনে চোখের পানি ছেড়ে দেন মহিন। অশ্রুমাখা কন্ঠে বলেন, ‘আমাদের কষ্ট আল্লাহ ছাড়া কেউ দেখে না ভাই। ছোট্ট একটা মেয়ে হইছে গত রোজার ঈদের আগে। বাবা হয়ে একটা সুতাও কিনে দিতে পারি নাই মেয়েটারে।’


গায়ে থাকা টি-শার্টে চোখের জল মুছতে মুছতে মহিন বলেন, ‘পুরুষ মানুষ অল্প কষ্টে কাঁদে না ভাই! করোনা সময়টা কিভাবে কাটিয়েছি এক আল্লাহ সাক্ষী। আমরা তো কারো পরিচিত না, তাই কোনো অনুদানও পাই না। কোরবানি আসলে প্রতিবেশী আত্মীয়রা গরুর মাংস দেয়। কোরবানি ঈদে যে গরু মাংস খাইছি আর খাই নাই!’
এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, এখন যা ইনকাম হয় তা দিয়ে কোন রকম চলছে সংসার। দিন শেষে আয়-ব্যয় সমান সমান। এক ছেলে এক মেয়ে, স্ত্রী ও মা’কে নিয়ে তার পরিবার।

রিক্সা চালক বিল্লাল হোসেন। নগরীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত। নিত্য ছুটে চলার ব্যস্ততা তার। গাইবান্ধা থেকে কুমিল্লা এসেছেন ১ বছর হলো। আগে ঢাকায় রিক্সা চালাতেন। এখন সেখানে ব্যাটারি চালিত রিক্সা চলাচলে অনুমোদন নেই বলে কুমিল্লায় এসেছেন। ৩৫০ টাকা দৈনিক ভাড়া হিসেবে এক মহাজন থেকে রিক্সা নিয়েছেন। এতে প্রতিদিন ভাড়া কাটতে পারেন ৬-৭ শ টাকা। থাকেন ভাড়া মেসে। প্রতিদিন ১২০ টাকা দিয়ে দুইবেলা খাবার খান।

শেষ কবে গরুর মাংস দিয়ে খাবার খেয়েছেন? এমন প্রশ্নে বিল্লাল হোসেন লাজুক মুখে বলেন, ‘আমাদের কি আর বিলাসিতা মানায় স্যার? মাঝে মধ্যে বাসায় মেহমান আসলে মুরগী এনে খাই। কুরবানির ঈদে কেউ গরু মাংস দিলে খেতে পারি। কিনে খাওয়ার তো তৌফিক নাই আমাদের।’ বিল্লাল হোসেনের ইনকাম প্রতিদিন ৩০০-৩৫০ টাকা। দুই ছেলে স্ত্রী ও বাবা মা নিয়ে তার পরিবার।


নগরীর মোগলটুলি এলাকার চা দোকানি নজরুল ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘গরুর মাংস কিনে খাওয়ার সাহস হয় না ভাই। এই বছরে গরু মাংস খাই নাই। সাত-আট মাস আগে কিনে খেয়েছিলাম। গরুর মাংস বড় লোকের খাবার হয়ে গেছে।’
এক মেয়ে দুই ছেলে, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি থাকেন মোগলটুলির শশুরবাড়িতে।
ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মো আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে গরুর মাংস ৬৫০ টাকা ধরে বিক্রির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ অসদুপায় অবলম্বন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।