নৈসর্গিক শহরে মেঘের সাথে মিতালী
মহিউদ্দিন আকাশ
অ্যাই রহমান, নান্টু, তৈয়ব, মাসুদ শোনো। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের ডাকে নীরবতা আমাদের আড্ডায়।
সাধারণত প্রতি বুধবার কুমিল্লা নগরীর পুরাতন চৌধুরীপাড়ায় সাপ্তাহিক আমোদ অফিসে বসে রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম সদস্যদের আড্ডা ও সংবাদ পর্যালোচনা। সেদিনও তেমনই এক আড্ডার মাঝে মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই সবাইকে জানালেন আমরা আনন্দ ভ্রমণে যেতে চাই। কথা শেষ না হতেই মাহফুজ নান্টু ভাই, হাত তুলে বললেন- সবার পক্ষ থেকে আমি উক্ত প্রস্তাব সমর্থন করলাম।
কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? কেউ বললেন সিলেট কেউবা সুন্দরবন। কেউ কেউ বললেন – মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড় সাজেক ভ্যালি যাই।
এক রকম বিতর্ক প্রতিযোগিতা শেষে সিদ্ধান্ত হল সাজেক যাব। ভ্রমণের তারিখ নির্ধারণ হল ১৪ অক্টোবর। অনেক দিন পরে দীর্ঘ ভ্রমণে যাব। সবাই আনন্দের সাথে শপিং করলো। আব্দুর রহমান ও মাহফুজ নান্টু ভাই তো শেভ করে একবারেই ফিটফাট। কিন্তু হঠাৎ পাল্টে গেল কুমিল্লার চিত্র। ভ্রমণের ঠিক আগের দিন সকালে পূজামণ্ডপে কুরআন রাখাকে কেন্দ্র করে শান্ত কুমিল্লা হয়ে গেল রণক্ষেত্র। সকলে অ্যাক্টিভ সাংবাদিক হওয়ায় বেড়ে গেল ব্যস্ততা। পরের দিন ১৪ অক্টোবর আর ভ্রমণে যাওয়া হল না।
তবে কি ভ্রমণ বন্ধ? অসম্ভ! ভ্রমণ হবেই কুমিল্লা একটু শান্ত হোক। জোর গলায় বললেন রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম সভাপতি মাসুদ আলম। এর মাঝে একটা তারিখও হলো। তবে সে তারিখে পূজামণ্ডপে কুরআন রাখা ইকবাল গ্রেফতার হল। যার ফলে সেবারও মিস হল আমাদের সাজেক যাত্রা।
রাইজিং মানেই তো উদীয়মানদের সংগঠন। এদেরকে কি ধমিয়ে রাখা যায়! সকল জল্পনা কল্পনা শেষে ২৯ অক্টোবর জুমআর পূর্বে আমোদ অফিস থেকে যাত্রা শুরু। শুরুতে আমরা দেখা করলাম সাপ্তাহিক আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বীর ভাইয়ের সাথে। তিনি কিছু পরামর্শ দিলেন। পেলাম তার উপহার। এই উপহার আমাদের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করল। কিছুদূর গিয়ে চৌদ্দগ্রামের একটি মসজিদে জুমআ আদায়। ফেনীতে গিয়ে দুপুরের খাবার গ্রহণ। বিকেল ৩টায় শান্তি পরিবহণে নৈসর্গিক শহর খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা। পথিমধ্যে জানালা দিয়ে সবুজের সমরোহ দেখে মুগ্ধ সবাই।
খাগড়াছড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত ৮ টা। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার কুমিল্লা প্রতিনিধি আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই। তার কলিগ জহুরুল ইসলাম ভাই আমাদের থাকার জন্য হোটেল ঠিক করে দিলেন। সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে গেলাম। জহুরুল ভাইয়ের পরামর্শে ব্যাম্বো সুডে। সেখানে গিয়ে তো সবাই অবাক। চারদিকে বাশঁ আর বাঁশ। বাঁশ দিয়ে তৈরি এ রেস্টুুরেন্টে খাবারেও দেয়া হল বাঁশ দিয়ে রান্না তরকারি। নতুন এ রেসিপি পেয়ে সবাই তৃপ্তি সহকারে খেল।
সারাদিনের জার্নি শেষে এবার ঘুমানোর পালা। কিন্তু সে ঘুম আর হল না। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের চমৎকার স্মৃতিচারণ,আব্দুর রহমান ভাইয়ের মজার রাজনৈতিক বক্তব্য, মাহফুজ নান্টু ভাইয়ের গ্রাম্য খনার বচন আর অভিজ্ঞতার গল্প,আমার তাহেরী জিকির ও ইঁদুরের ঔষধ বিক্রির মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল। হাসতে হাসতে সবাই ঘুমাতে গেলাম।
দেরি করে ঘুমালেও সকালে আমাকেই আগে উঠতে হল। কারণ সাজেকে যাওয়ার জন্য চাঁদের গাড়ির সিরিয়াল ধরতে হয়। ঘুম থেকে উঠে কম্বলের ভিতর থেকেই শরীফ খানকে ডাকলাম। তিনি উঠে আমাদের জন্য চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করলেন।
নাস্তা সেরে চাঁদের গাড়িতে আমরা রওনা হলাম মেঘের রাজ্যে। যেখানে মেঘ আর রোদ খেলা করে।
সাজেকের আকাঁ বাঁকা পথে চাঁদের গাড়ি চলছে আপন গতিতে আর আমরা মেতে উঠেছি গান আর কৌতুকে।
বিশাল বিশাল পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আমাদের গাড়ি যাচ্ছে।
দুপুর নাগাদ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে আমরা পৌঁছলাম সাজেকে। পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সাজেক নদীর নামেই সে এলাকার নাম সাজেক। সেখানে আমরা কাঠের তৈরি বাসভবনে উঠলাম। যা সাজেকের হেলিপ্যাডের পাশেই অবস্থিত।
দুপুরে পাহাড়ি খাবার শেষে আমরা রওনা হলাম পাহাড়ের কান্না ঝর্ণা দেখতে। একটু দূর যেতেই পর্যটকরা বলল..যেতে আসতে ৫/৬ ঘন্টা লাগবে। অনেক কষ্টের পথ। পা ব্যথা হয়ে যাবে। তাদের কথা শুনে আমরা একটু ভয় পেলেও সাহস হারাইনি। তবে আব্দুর রহমান ভাই ও শরীফ খান ভয়ে আর এগুলেন না। তারা হোটেলে ফিরলেন। আমরা গেলাম ঝর্ণার উদ্দেশ্য।
একটু দূর যেতেই একদল বলল- নির্জন পথ গাইড ছাড়া যাবেন না। বিপদ হতে পারে। এবার আমরা ঝর্ণায় যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল।
একটা শর্টপ্যান্ট পরা খালি গায়ের একজন পাহাড়ি পেলাম। তিনি নিজেকে গাইড পরিচয় দিলেন। ৫০০ টাকার বিনিময়ে তিনি আমাদের সেই ঝর্ণায় নিয়ে যাবেন।
নান্টু ভাই তার নাম জিজ্ঞেস করলেন – সে নাম বলল “টারজেন”। একটু দূর যেতেই তার অস্বাভাবিক আচরণ ও গহীন বন ও পাহাড়ের উচু নিচু পথ দেখে ভয় পেয়ে পেলেও মুখ খুলিনি। নির্জন আকা বাঁকা পথ চারদিকে গাছ আর ঝোপঝাড়। প্রায় ১ ঘন্টা হাঁটার পর সন্ধান পেলাম সেই সৌন্দর্যের অপরুপ চিত্র কংলাক ঝর্ণা। পাহাড় থেকে নেমে আসা সেই পানির মিষ্টি শব্দের তালে তালে নাচলেন টারজান নামের সেই গাইড। ঝর্ণার পানিতে গোসল করে আবারো রিসোর্টে ফেরার পালা। তবে সবাই ক্লান্ত শরীরে আস্তে আস্তে হাঁটছে যেন আর পা চলছে না। উঁচু নিচু পথ ধরে কষ্ট করে আমরা হাঁটছি। সেই টারজান শুধু বকবক করছেন। নান্টু ভাইকে তো বলেই ফেললেন কি খাও মিয়া? আমার দিকে দেখে ৫ বার আসছি গেছি।
নান্টু ভাই রাগে তার নাম দিলেন শাঘশা। সে বলল তার নাম আকাশের উপরে কালাচান আর নিচে টারজান। আমরা তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম শাঘশাও ভাল নাম। এর মুল ব্যাখা শুধুমাত্র নান্টু ভাই জানে।
ক্লান্ত শরীরে রিসোর্টে এসে সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেলাম। সন্ধ্যায় হেলিপ্যাডে গেলাম। সেখানে গিয়ে মনে হল এক খন্ড ধর্মসাগরপাড়। চারদিকে চলছে নানান আয়োজন। কেউ ফানুস উড়াচ্ছে কেউ গান আর আড্ডায় ব্যস্ত। আমরা এক পাশে বসে আব্দুর রহমান ভাই ও নান্টু ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে গান ধরলাম। আসার পথে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত শপ থেকে পাহাড়ি শপিং করে রিসোর্টে ফিরলাম। রিসোর্টের বারান্দায় বসে মেঘের সাথে মিতালির সাথে সাথে চলল গান। শরীফের উপস্থাপনায় নান্টু ভাই গান ধরলেন- পিরিতি শিখাইয়া ভাবেতে মজাইয়া চলে গেল প্রাণের হাসি-হাসি।
রহমান ভাই আর মাসুদ ভাই গানের বিশ্লেষণ করলেন। নান্টু ভাই বললেন- হাসি নামে মূলত তার কোন প্রেমিকাই ছিল না।
গান শেষে আমরা স্ব-ইচ্ছায় আবারও বাঁশ খেলাম। মুরগিরর মাংস বাঁশের ভিতরে রেখে এক রকমের রেসিপি হয়। যার নাম ব্যাম্বো চিকেন। সাথে ছিল বাঁশের স্পেশাল রেসিপি ও পাহাড়ি সবজি।
তারপর পাহাড়িদের সাথে চায়ের আড্ডা। ক্লান্ত শরীর। রাতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই তো অবাক। মেঘ যেন গাঁ ছুয়ে যায়। হাতে স্পর্শ করা যায় মেঘকে। একটু দূরে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে সবাই আনন্দঘন মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করে নিল।
তারপর চাঁদের গাড়ি করে আমরা গেলাম ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে কংলাক পাহাড়ে। উঠতে একটু কষ্ট হলেও সেখানকার সৌন্দর্যে সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
পাহাড়িদের জীবনযাত্রা সত্যিই অবাক করার মত। পাহাড়ের উঁচুতে দাঁড়িয়ে সবাই আনন্দের সাথে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করল। সেখানকার চা দোকানে অচিং চাকমা দিদির চা পান করলাম। আমরা গেলাম ঐতিহ্যবাহী লুসাই সম্প্রদায়ের গ্রামে। তাদের ব্যাতিক্রমী পোশাক, ভাষা,জীবনাচারণ মুগ্ধ হওয়ার মত।
তবে এবার ফেরার পালা। মেঘের শহর ছেড়ে আমরা ফিরছি রোদের রাজ্যে। যেখানে সাজেকের সেই মেঘের হাতছানি নেই। নেই সবুজের সমরোহ। সবাই কুমিল্লা নগরীর ইট পাথরের জঞ্জালের দিকে ফিরছি!
সাজেক থেকে ফেরার পথে পাহাড়ি শিশুরা হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানায়। আমরাও চকলেট দিয়ে তাদের উৎসাহিত করি। শিশুদের হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানানোর দৃশ্য যেন হৃদয় ছোঁয়ে যায়। মন ফিরে যায় আবার পাহাড়ের সহজ সরল মানুষদের কাছে। ফিরে যায় মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়ে।