বদলে যাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম! –মনোয়ার হোসেন রতন

 

 

inside post

ভাষা সৈনিক মনির চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের একটি বিখ্যাত সংলাপ আছে, ‘মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, সকালে-বিকালে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে সব কিছুই বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছি আমরাও। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা এগিয়ে যেতে আমরাও পড়া-লেখা, গুণা, শেখার ধরন পাল্টে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি! বদলে যাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।এক বিংশ শতকের ভাঙ্গা-গড়া, উত্থান-পতনের ইতিহাসের এ সময়ে আমরা শিক্ষাকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছি তা ভাবনার বিষয়! প্লেটোর মতে, শিক্ষা হলো এমন এক ধারণা শক্তি যা সঠিক মূহূর্তে আনন্দ ও বেদনা অনুভবে সাহায্য করে। এটি শিক্ষার্থীর দেহ ও মনের সৌন্দর্য ও অন্তনিহিত পূর্ণতাকে বিকশিত করে। অ্যারিস্টটলের মতে, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মনের সৃষ্টিই হলো শিক্ষা। এটি মানুষের মধ্যে এমন এক সত্তার আবির্ভাব ঘটায় যার দ্বারা মানুষ শ্বাশত সত্য, মহত্ত্ব এবং সুন্দরের আরাধানায় নিজেকে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়’। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো, আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত শিক্ষা ছিলো বেঁচে থাকার জন্য নানান কৌশল আয়ত্ব করা, যেমন, বাসস্থান নির্মাণ, পোশাক তৈরি এবং খাদ্য সংগ্রহ ইত্যাদি। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, বিদ্যা শিক্ষা কাকে বলি? বই পড়া? নানাবিধ জ্ঞান অর্জন করা? তাও নয়। যে শিক্ষার দ্বারা ইচ্ছাশক্তির বেগ ও ফূর্তি নিজের আয়ত্তাধীন ও সফলকাম হয়, তাই শিক্ষা।

খুব সহজেই আমরা বলতে পারি, আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয়, সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান, দক্ষতা বিকাশ সাধনের মধ্যদিয়ে নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই.এল.ও)র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ এমন কাজ করছেন, যার সংগে শিক্ষা সামজ্ঞস্যপূর্ণ নয়। এদিকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের শ্রম শক্তির নয় দশমিক নয় শতাংশকে ঠিক ঠাক কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দেশের শ্রম শক্তির ছয় শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত, নারীদের মধ্যে এ হার মাত্র ৩.৮ শতাংশ। ভাবনার বিষয়, দেশে ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা শ্রমশক্তির আট দশমিক তিন শতাংশ, যদিও উচ্চ শিক্ষিত কর্মীর অনুপাতের চেয়ে কম। এখানে উল্লেখ করতে হয়, আই.এল.ও একশত ত্রিশটি দেশের শ্রমশক্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, বিশ্বের মাত্র অর্ধেক শ্রমশক্তি শিক্ষাগত যোগ্যতার সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি করছেন, বাকীরা অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নিম্ন দক্ষতার চাকরি করছেন বা যে কাজ করছেন তার জন্য যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁদের নেই।
এ রকম এক ভয়াবহ পরিস্হিতির মধ্যে এসে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি, নতুন এক শিক্ষাক্রম। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন)বেশী হবে।এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণী গুলোর মূল্যায়ন পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম দুটোই থাকছে। নতুন নিয়মে এখনকার মতো এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এস.এস.সি পরীক্ষা।একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচ.এস.সির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। এনসিটিবির সূত্রমতে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বছর থেকে প্রথম শ্রেণী ও ৬ষ্ট শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। বিভিন্ন শ্রেণীতে তা পর্যায়ক্রমে চালু হবে পরের বছর থেকে।এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ট ও সপ্তম শেণী, ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণী, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম।এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণীতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। পাল্টে যাবে সব, মূল্যায়ন পদ্ধতি, সাপ্তাহিক ছুটি এবং অন্যান্য অনেক কিছুই।
দশম শ্রেণী পর্যন্ত শাখার বিভাজন থাকবে না, সবার জন্য অভিন্ন বিষয়। শুধু দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচিতে এস.এস.সি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষার ভিত্তিতে এইচ এস সির ফল। ২০২৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু। ২০২৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন। পাল্টে যাবে পাঠ্যবই, শিখন পদ্ধতি। উচ্চ মাধ্যমিকে ছয় বিষয়ের মধ্যে তিনটি বাধ্যতামূলক। বাকী তিনটি বিষয় পছন্দমতো। সর্তীথরাও মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীদের।
আমরা চাই, জীবনমুখী, বাস্তবমুখী, সময় উপযোগী শিক্ষা। যে শিক্ষা আমাদের মানসিক শক্তির বিকাশ সাধন করবে, সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হবে, আগামী প্রজন্ম মূক্ত চিন্তার ধারক হয়ে বেড়ে উঠবে। চাপমুক্ত শিক্ষা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের সমাজ থেকে সহিংসতা, প্রতারণা, আত্মহত্যা, বেকারত্ব, হতাশা, বৈষম্য দূর হবে। মানসিক ক্ষতির মধ্যে যেন কাউকে পড়তে না হয়। পুঁথিগত শিক্ষা এবং বাস্তবমুখী, জীবনমুখী শিক্ষার সমন্বয়ে নতুন শিক্ষার কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমাদের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যাবে। তবে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে জাতীয় বাজেটের একটা বড় অংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্ধ করা। নতুন শিক্ষা কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে হলে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণকারী কিছু আইনের ও প্রয়োজন হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসেবে যদি লিখি তাহলে, একাডেমিক ডিগ্রি নিয়ন্ত্রণ আইন, বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন, শিক্ষক আইন, শিক্ষা আইন, পেশাগত শিক্ষার আইন, উচ্চ শিক্ষার আইন ইত্যাদি। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি, ১০২ টি দেশের শিক্ষাক্রম সংক্রান্ত নথি বিশ্লেষন করে ৫১টি দেশ এরই মধ্যে রুপান্তর যোগ্য দক্ষতা ও যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছেন। আমাদের শিক্ষানীতি হয়তো সেদিকে যাচ্ছে! আমরা চাই, শিক্ষার সংগে কাজের মিল। মিল-অমিলের গোলক ধাঁধাঁয় পড়লে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সক্ষম হবো না। অক্ষমতা নিয়েই নতুন এক দাসত্বের মধ্যে প্রবেশ করবো! আমাদের নীতি নির্ধারকগণ নিশ্চয়ই প্রতিদিনের নতুন নতুন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বিপ্লব, চ্যালেঞ্জ, মোকাবেলা করার সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে সময় উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম বা শিক্ষানীতি দেবেন। বেগম রোকেয়ার মতে, ‘শিক্ষার অর্থ সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। সৃষ্টিকর্তা যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা’।একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়েই এ লেখা শেষ করছি, ‘বেঁচে থাকা চালিত শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু করে সিঙ্গাপুর তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। শিক্ষার জন্য তাঁরা জাতীয় বাজেটের বিশ শতাংশ শিক্ষার উপর ব্যয় করে। এ শিক্ষা মূলত বেকারত্ব কমিয়ে আনা এবং দক্ষ কর্মী সরবরাহের জন্য করে থাকেন। সুতরাং আমরাও তা করে দেখতে পারি।

আরো পড়ুন