বসিলার আকাশে এখনও হেলিকপ্টার উড়ছে!

সানোয়ার হোসেন।।
২৯ জুলাই দেশের দৈনিক পত্রিকা গুলো সংবাদ ছাপিয়েছে। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যেসব শিক্ষার্থী মানসিক ট্রমায় ভুগছে, তাদের কাউন্সেলিং সেন্টারে নিয়ে আসছেন অভিভাবকেরা। উদ্দেশ্য, এই শিক্ষার্থীদের মানসিক ট্রমা থেকে বের করে আনা। পড়ালেখায় মনোযোগী করা। আবার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা কাছ থেকে দেখা অভিভাবকেরা কাউন্সেলিং নিচ্ছেন। এই সংবাদ দেখে মনে পড়লো গত বছরের জুলাইয়ের ঘটনা। সহধর্মিনীকে নিয়ে বিয়ের পর প্রথম ঢাকায় বেড়াতে যাওয়া। ২০২৪ এর জুলাই ১ তারিখ। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। ভোরবেলা দুই সন্তানসহ আমরা ছয়জন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। জুলাইয়ের ৪ তারিখ অনেক আয়োজনে মেয়ের ২য় জন্মদিন পালন হলো। ছেলের সবেমাত্র ৭ মাস। চারপাশে বালিশ দিয়ে বসানো যায়। আরামবাগ থাকা ফুফু শাশুড়ি দাওয়াত করলেন তাদের বাসায়। নতুন জামাই, সাথে বাচ্ছাদের প্রথম যাওয়া। ১১ জুলাই দুপুর। ১টার কিছু পর পর বসিলা মূল সড়ক থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিলাম আরামবাগ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। দরদামের সময় সিএনজি অটোরিকশা চালক ছাত্রদের আন্দোলনে রাস্তা বন্ধ, ঘুরে যেতে হবে বলে বাড়তি ভাড়া দাবি করলেন। ফার্মগেট, সাইন্সল্যাব থেকে শুরু করে কিছু ছোট গলি দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তীব্র গরমে ঠাসাঠাসি করে সিএনজিতে বসা তিনজনের কোলে তিন শিশু। তাদের অস্থির করে তোলা কান্নাকাটি দেখিয়ে সাইন্সল্যাব দিয়ে ছাত্রদের দুইটা বাঁধা পার হতে পেরেছিলাম। তারপর বাচ্চাদের কান্নাকাটি দেখিয়েও আর সামনে এগোনো যায়নি। বাধ্য হয়ে পৌনে চারটার দিকে বসিলার দিকে রওয়ানা হই। সন্ধ্যায় ব্লকেড ছেড়ে দেয়ার খবর পাই। রাত ৯টার পর আরামবাগ ফুফু শাশুড়ির বাসায় যাই দাওয়াত খেতে। ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার, সারাদেশে ছাত্রদের আন্দোলন তীব্র হয়েছে। বসিলা মূল সড়ক অবরোধ করেছে ছাত্ররা। পুলিশের ঊর্ধ্বতন দুই একজন কর্মকর্তা আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলে গেলেন, পুলিশ সদস্যরা দূরে অবস্থান করছে। আশপাশের মাদ্রাসা গুলো আন্দোলনকারীদের নাস্তা পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে। মাদ্রাসা ছাত্ররা আমাদের দোকানে আসে ওয়ান টাইম প্লাসের জন্য, ফ্রি তে সেই গ্লাস দিয়ে অন্যরকম সুখানুভূতি হলো। সেদিন দেখলাম আন্দোলনে সব বয়সী মানুষ যোগ দিয়েছে। ১৯ তারিখ শুক্রবার। জুম্মার নামাজ শেষে ইমাম মোনাজাতে সব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে আন্দোলনে নিহত ও আহতদের জন্য দোয়া করলেন। জালিমের হাত থেকে মজলুমদেরকে হেফাজতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। সকল মুসুল্লির মুখ থেকে সুউচ্চস্বরে ধ্বনিত হলো আমিন। নামাজ শেষে সব মুসুল্লি চলে গেল বসিলা বড় রাস্তায়। কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই সব মসজিদ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গেল। বসিলার যে জায়গায় সবাই জড়ো হয় তার ১০০ মিটার দূরেই র্যাব-২ এর মূল ফটক। মুক্তির শ্লোগান দিতে দিতে জড়ো হওয়া সবাই চললো মোহাম্মদপুরের দিকে। পথে এপিবিএন বাধা দেয়ায় ফিরতি পথে র্যাব-২ এর সামনে আসার পরপরই শুরু হয় সরাসরি গুলি। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে কয়েকজন। ছত্রভঙ্গ আন্দোলনকারীরা দূরের আড়াল থেকে ঢিল ছুড়তে থাকে। আন্দোলনের শুরু থেকে নীরব থাকা র্যাব-২ এর ভেতর থেকে তাজা বুলেট ছুড়তে ছুড়তে বেরিয়ে আসে বাহিনীর সদস্যরা। বেঁধে যায় তুমুল সংঘর্ষ। র্যাবের সহায়তায় হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া হচ্ছে সাউন্ড গ্রেনেড আর কাঁদানে গ্যাস। তখন আসরের নামাজ শেষ করে মসজিদে আটকা পড়ি আমরা দুই ভাই। ঠিক ওই সময় বসিলা ওয়েস্ট ধানমন্ডির হাউজিং এর এ ব্লকের ৬ নাম্বার রোডের বাসা থেকে আমার ভাইয়ের বউ, ভাতিজি, আমার সহধর্মিনী, কোলে ৭ মাস বয়সী ছেলে ও দুই বছরের মেয়ে। ওরা হাউজিং এর মূল সড়কের কাছাকাছি এসেছে। সংঘর্ষ হাউজিং এর ভেতর না এলেও ঠিক ওই সময় মাথার উপরে চক্কর কাটা হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষেপ করা সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারগ্যাস পড়ে বউ বাচ্চাদের সামনে। বিকট শব্দে আতঙ্কগ্রস্ত ওরা দৌঁড়ে আশ্রয় নেয় পাশের দোকানে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়ে এলে ওরা বাসায় ফেরে। তারপর শুরু হয় আমার দুই বছর বয়সী মেয়ের আতঙ্গে কেঁপে ওঠা, হঠাৎ করে ভয়ে ঝাপটে ধরা। এরপর যতবারই বসিলার আকাশে হেলিকপ্টার উড়েছে ততোবারই মেয়ে ভয়ে আঁৎকে উঠেছে। ১৯ তারিখের পর বসিলার আকাশে হেলিকপ্টার উড়েছে আরো কয়েকদিন। কারফিউ শিথিল করার পর ২৬ তারিখ মেয়ের হেলিকপ্টার আতঙ্ক নিয়ে বাড়ি ফিরি। গাড়ির হর্ন আর উচ্চশব্দে আঁৎকে উঠে বার-বার। আমাদের বাড়িটা ফসলি মাঠের পাশে। নিকটে কোন বাড়ি নেই। যানবাহনের চলাচল নাই। বছরের এই সময়টা আমন রোপনের সময়। চাষের জন্য ট্রাক্টর আসে। পরদিন এই ট্রাক্টরের শব্দে মেয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বাবার গলা ঝড়িয়ে ধরে। জুলাই আগস্ট যায় কিন্তু হেলিকপ্টার ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দের আতঙ্ক থেকে যায় আরো অনেক মাস।
লেখক: সংবাদকর্মী।
