তাঁদের স্বপ্ন ছিলো নতুন একটি বাংলাদেশ!

ইলিয়াছ হোসাইন।।
১৮জুলাই। আকাশের কালো মেঘ জমাট বেঁধে আছে। তার ফাঁকেই সূর্যের আলো এসে পড়ছে রাজপথে।পুলিশের রাইফেলসের মুখে দু’হাত মেলে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো হেংলা পাতলা গড়নের এক বীর,আবু সাইয়িদ! তার বিশ্বাস ছিল তার দেশের পুলিশ তার বুকে গুলি চালাবেনা। সামনে এগিয়ে গেলে বুলেট বের হওয়ার শব্দ হলো। লুটিয়ে পড়লো শরীর। প্রথম গুলিটা গায়ে লাগার পর বিশ্বাস নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো। নিজের দেশের পুলিশ পরপর আবার গুলি চালালো। তখনও যেন তার বিশ্বাস এক বিন্দুও কমেনি। আবার উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু উঠতে পারছেনা। শরীর থেকে রক্ত হু হু করে বের হচ্ছে। আবু সায়িদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। বন্ধুরা অস্ত্রেও মুখে টেনেটুনে রাজপথ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। আবু সাঈদের আত্মা যেন তখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা :নিজের দেশের মানুষ তার উপর গুলি চালাতে পারলো। আবু সাঈদের হাত ঝুলছে,স্বপ্ন ডানা হাত। মুখে যেনো আত্মত্যাগের পবিত্র হাসি। রক্তের বিনিময়ে নতুন একটি বাংলাদেশ পাওয়ার বিমূর্ত হাসি!
আবু সাঈদ হত্যার পর উত্তাল সারা দেশ। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মৃত্যুর পরোয়া না করে রাজপথে নেমেছে। মাথায় লাল-সবুজের পতাকা। মুখে বিদ্রোহী কবির গান’বলো বীর বলো উন্নত মম শির।’ কারো কারো মুখে বাজছে ‘কারার ঐ লোহ কপাট ভেঙে ফেলে কররে লোপাট!’ এসব গানে মাতওয়ারা পুরো দেশ। কেউ ঘরে বসে নেই। নজরুলের এই গান গুলো কাউকে ঘরে থাকতে দেয়নি; রাস্তায় নামিয়ে এনেছে আপামর জনতাকে।
পুলিশ বৃষ্টির মত গুলি ছুড়ছে। বীরেরা তবুও পিছু হটছে না। কারণ এ ছাত্ররা ৭১’র সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায় গড়ে উঠা সন্তান। রাজপথের ছাত্ররা বুক ফুলিয়ে বার বার বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেখিয়েছে- আমরা বীরের জাতি। পুলিশ ছাত্রদের নিশানা করে গুলি ছুড়ছে। নিরস্ত্র ছাত্ররা জীবন রক্ষার্থে ইটপাটকেল ছুড়ছে। বিকেলে সূর্য পূর্ব আকাশে হেলে পড়ছে। সূর্যের তেজস্ক্রিয়ায় নতুন একটি বাংলাদেশের জন্য জ¦লে উঠছে জুলাইয়ের বীরেরা।
পুলিশের গুলি বর্ষণ বন্ধ নেই। প্রচন্ড গরম। কাঁদানো গ্যাসে। যেনো কাঁদছে পুরো দেশ। মা-বাবার বুক তখন আর্তনাতে ভরা। অনেক জুলাই যোদ্ধা,জুলাই শহীদ মা-বাবাকে চিঠি লিখে না জানিয়ে যুদ্ধে যাই বলে লুকিয়ে এসেছেন। মিছিল, পাল্টাপাল্টি আক্রমণ,বীরদের গলা শুকিয়ে আসছে।
জনতার ফাঁকে কে যেনো চিৎকার করে করে ডাকছে :পানি লাগবে পানি? পানি লাগবে পানি? সে তো কেউ নয় এ যে বীর মুগ্ধ! তার এই একটি বাক্য সারাদেশের দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কিত হয়েছে। যে শব্দ মানুষের হৃদয়কে কাঁদিয়েছে। রণক্ষেত্রে পানি বিলানো এ বীরের রক্তেও রঞ্জিত হয়েছে কংক্রিটের রাস্তা। কেঁদেছে রাস্তার ধুলি কণাও। কিন্তু বন্ধ হয়নি গুলি। আমাদের টাকায় কেনা গুলি আমাদের উপরেই বৃষ্টির মত বর্ষিত হচ্ছে। কতো মায়ের বুক খালি হয়ে গেছে। কারো চোখে,কারো মাথায়,কারো পায়ে,পুরো শরীর গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। ছাদের উপর খেলা করা শিশুটা রক্ষা পেলোনা, বুলেটের আঘাতে মাথার খুলি ছিদ্র হয়েছে। ছিদ্র হয়েছে বাংলাদেশ! কলঙ্কিত হয়েছে ৭১’র মুক্তি যোদ্ধাদের অর্জিত স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ।

inside post

৩আগস্ট,
কুমিল্লার আকাশে ঘন-পাতলা কালো মেঘ। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় মিছিলে যোগ হচ্ছে। প্রায় কয়েক কি.মি.পথ জুড়ে সেই মিছিল। কুমিল্লার ইতিহাসে হয়তো সবচেয়ে বড় মিছিল। কান্দিরপাড়, জিলাস্কুল,ঈদগাহ পার করে যখন পুলিশ লাইন মোড় পৌঁছালো। শুরু হলো অতর্কিত হামলা। নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ। চোখে মুখে আর্তনাদ। বাসা বাড়ির গেইট গুলো বন্ধ। আশ্রয় নিতে গিয়ে কয়েকজন ছাত্রীর আত্ম চিৎকার:আঙ্কেল গেইটটা খুলেন না।নির্মতার করুণ পরিহাস গেইটটা সেদিন খোলা হলোনা। হামলাকারীদের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হলো বোনদের শরীর। রক্ত ঝরছে। সেই রক্ত হাতে নিয়ে তখনও যেন বিশ্বাস করতে পারেনি
কিভাবে আমার শহরের মানুষ আমাদের উপর লাঠি চালাতে পারে? তারাওতো আমাদের ভাই। কার জন্যে এই হামলা আমাদের উপর করলো?
দেশের পরিস্থিতি থমথমে অবস্থায়। এ কোন বাংলাদেশ দেখছি। যেনো একাত্তরের হাইলাইটস দেশের প্রতিটি জেলায় দেখছি। অন্ধকারে ডুবে গেলো দেশ। ১৪৪ধারা জারি। ছাত্ররা ৬দফা থেকে ১দফায় নেমে আসলো। ঘরে বসে রইলোনা কেউ। ঝুম বৃষ্টি আর ঝুম গুলি সহোদর ভাইয়ে পরিণত হলো। বৃষ্টি থেমে গেলেও গুলি থামলো না। ইন্টারনেট বন্ধ। সাংবাদিকরা সংবাদ পাঠানোর জন্যে ফিরে গেলো আশির দশকের গোড়ায়। দেশের মানুষের প্রবল আগ্রহের চোখ পত্রিকার শিরোনামে। টেলিভিশনের পর্দায়।
কি হচ্ছে দেশে? এতো এতো মায়ের বুক খালি হয়ে গেল। কেনো, কোন আশায়?
সরকার পতন নাকি নতুন একটি বাংলাদেশের আশায়?
৫আগস্ট ঘোষণা হলো ঢাকা টু লংমার্চ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হলো। আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা। ইন্টারনেটসহ সকল যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ। কি হচ্ছে আগামীকাল? আঁধারে বুনছে লাখো লাখো স্বপ্ন! রাত পোহাবার কতো দেরি পাঞ্জেরী? সুবহে সাদিকের রঙ মাড়িয়ে ভোরের আলো ফুটলো।
৫আগস্ট লক্ষ লক্ষ জনতায় গিজ গিজ করছে রাজধানীজুড়ে। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাদের দমিয়ে রাখতে পাওে নাই। তারা জড়ো হলো জাতীয় সংসদ ভবন জয় করলো। সরকারের পতন ঘটিয়ে গণভবনে ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো বীরেরা। জয়ধ্বনিতে মুখরিত সারাদেশ। বিজয় মিছিলে উত্তাল বাংলার রোড-ঘাট। ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হলো। জুলাইয়ের রক্তের বিনিময়ে ৭১’র মুক্তিযোদ্ধাদের বিনির্মাণে জুলাইয়ের নতুন একটি বাংলাদেশ।
লেখক:আলোকচিত্রী।

আরো পড়ুন