জুলাই বিপ্লব: বাংলাদেশীদের মুক্তির সংগ্রাম

আলমগীর মোহাম্মদ ।।
সকল সরকারকে সুবিধাবাদী এবং সকল প্রকার ভোটকে জুয়ার সাথে তুলনা করেছেন মার্কিন রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম পুরোধা হেনরি ডেভিড থরো। অন্যায়, অন্যায্য আইন এবং সরকারের জুলুম যুগে যুগে থাকে। তো, আমাদের করণীয় কী। এমন প্রশ্নের জবাবে বলা যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যায্য আইন সংশোধনে চাপ প্রয়োগ এবং জুলুম প্রতিহত করাই একজন নাগরিকের কর্তব্য। প্রসঙ্গে কনফুসিয়াসের একটি উক্তি উল্লখ করা যায়। কনফুসিয়াস বলেছেন,” একটি রাষ্ট্র যদি নিয়মনীতি / সংবিধানের আলোকে পরিচালিত হয় সেখানে দারিদ্র্য এবং জনদুর্ভোগের উপস্থিতি লজ্জার; এবং একটি রাষ্ট্র যদি নিয়মনীতির আলোকে পরিচালিত না হয়, সেখানে সম্পদ ও ঐশ্চর্যের মালিক হওয়া লজ্জার।“ বাংলাদেশ সেই লজ্জার সম্মুখীন হয়েছে গত ষোলো বছরে।


প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেশন অথবা সরকারের আসলে কোনো বিবেচনাবোধ বা বিবেক নেই। বিবেকবান মানুষের হাতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান-ই বিবেচকের কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এখানেই। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বিবেকহীন এবং নীতিনৈতিকতাশূন্য। এই নৈতিকতাহীনতার যাত্রা শুরু হয় স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচন দিয়ে। এই নির্বাচনে স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের পুরনো কলংকের ঘের থেকে বের হতে পারেনি। সীমাহীন দুর্নীতি ও কারচুপির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করে। এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনই ছিলো আমাদের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের দুর্ভোগের প্রথম মঞ্চায়ন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেকটি কলংকিত অধ্যায় হলো ২০০৯-২০২৪। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দলের উপর দমন নিপীড়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধবংস, রাতের ভোট, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫১ আসনে এমপি নির্বাচন, গুম, খুন এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় গুণ্ডাতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে শত শত ছাত্রজনতা খুন ছিলো গত ষোলো বছরের স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের আমলনামা। কথায় আছে, আগুনের দিনগুলো শেষ হবে একদিন। ঠিক গত বছরের জুলাই বিপ্লব আমাদের আগুনের দিনগুলো শেষ হ ওয়ার একটা বার্তা নিয়ে আসে।
১৬ জুলাই আমি চট্টগ্রামে অবস্থান করি। ঐদিন চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিমের মৃত্যু সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়। এরপর ১৮ জুলাই প্রথমবারের মতো আমাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আসে তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই আমার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করব শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার। আমার ইউনিভার্সিটিতে আমি আবাসিক হলের একটা দায়িত্বে থাকায় বিষয়টা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটা রেজিমেন্টেড প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থেকে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করি স্বৈরাচার প্রতিরোধে সংগ্রামে। ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের যে দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি খন্ডকালীন পড়াই এবং শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত একটা বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে আমি সর্বশেষ পড়িয়েছি ওখানকার শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ি প্রতিরোধে। সাথে লেখালিখি ছিলো। বিক্ষুব্ধ কবি- লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওইয়ার্ক ছিলো অন্যতম প্ল্যাটফর্ম।
পেশা ও ব্যক্তিত্বের ধরন অনুযায়ী প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিহত করার নেচার আলাদা হতে পারে। জুলাই বিপ্লবে আমার অংশগ্রহণ প্রথমত একজন শিক্ষক হিসেবে। দ্বিতীয়ত একজন লেখক হিসেবে। তৃতীয়ত একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাজে কিছু প্রেজ্যুডিস চালু আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এরা রাজনীতিসচেতন না এবং সামাজিক আন্দোলন বা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই বা আগ্রহ নেই। সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আমাদের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে শিক্ষার্থীদের উপর সরকার ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রতিবাদে। তাদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকলে জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়তো নতুন করে ভাবতে হতো। স্বৈরাচারী শাসন দীর্ঘায়িত হতে পারতো।
জুলাই আন্দোলন আমাদের নতুন প্রজন্মকে রাজনীতি সচেতন করেছে। ‘আই হেইট পলিটিক্স’ জাতীয় নাকউচুতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ছিলো এই জুলাই বিপ্লব। জুলাই বিপ্লব শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছে ‘ ঝড় আসবে আসুক, বুক চিতিয়ে লড়তে হবে’। সমাজে অন্যায় চলতে দেওয়া যাবে না। দানবের জন্ম ঠেকাতে সবাইকে একযোগে নেমে পড়তে হবে যে কোনো অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম শ্লোগান ছিলো বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা। স্বাধীনতা, সাম্য , সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে আগাগোড়া অনিচ্ছুক একটি সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া ছাত্র-জনতার হাতে আর কোনো বিকল্প ছিলো না। সেই দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি ছোড়া হলে দেশবাসী ফুসে উঠে জাহেল আওয়ামী লীগ, তাদের দ্বারা পরিচালিত সরকার ও স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। একজন সুশাসক একটি রাষ্ট্রের জন্য আশীর্বাদ। আর একজন দুঃশাসক একটি রাষ্ট্রের জন্য গজব স্বরূপ। শেখ হাসিনা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা আসমানি ও জমিনী বালার সমন্বয়।
শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে ৩৬শে জুলাই বাংলাদেশ জাহেলিয়াত যুগ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। দেশবাসী মুক্তির স্বাদ পায়। আশায় বুক বাঁধে একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের। চারদিক থেকে দাবি উঠে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অনিয়ম সংস্কারের। ফ্যাসিবাদের কলংক থেকে মুক্তির পয়গাম সবার মনে এই আশা জাগায় যে একদিন এই রাষ্ট্র হবে ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যমুক্ত। তবে ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট সেটা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জুলাই অভুত্থানে ফ্যাসিবাদী জালেম শক্তির দ্বারা সংগঠিত নারকীয় গণহত্যার বিচার করা, দেশের অভ্যন্তরে শান্তিশৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করা, দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা মানসম্মত পর্যায়ে উন্নীত করা, চিকিৎসাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। জুলাই অভুত্থানে প্রত্যক্ষ -পরোক্ষভাবে অংশ নেওয়া ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফল ঘটানোর একমাত্র কার্যকর মাধ্যম একটি সুষ্ঠূ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়া। এটা বাস্তবায়ন হলে জুলাই বিপ্লবে শহীদ হওয়া আমাদের ভাইবোনদের জন্য আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।