মানুষ ইতিহাস থেকে কিছুই শিখে না

মনোয়ার হোসেন রতন।।
জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন- “আমরা ইতিহাস থেকে যা শিখি, তা হলো- মানুষ ইতিহাস থেকে কিছুই শিখে না।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্নিঝরা দিন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের রক্তাক্ত বিপ্লব পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি রক্তপাত, প্রতিটি গণঅভ্যুত্থান হেগেলের কথাকে বারবার প্রমাণ করেছে। আমরা শাসক বদলাই, দল বদলাই, স্লোগান বদলাই—কিন্তু মৌলিক পরিবর্তনকে স্পর্শ করতে পারি না। ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও মানবিকতার ভিত্তি গড়ে ওঠে না। ইতিহাসের চাকা বারবার ঘুরে ফিরে একই রক্তাক্ত পথে দাঁড়িয়ে যায়।
২০২৪-এর অগ্নিবর্ষা: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
জুলাই–আগস্টের বিপ্লবে রাজপথ আবারও রক্তে ভিজল। তরুণদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রতিশ্রুতি—গণতন্ত্র, সমতা, শোষণমুক্ত সমাজ। কিন্তু বিপ্লবের আগুন নিভতেই আমরা দেখলাম ক্ষমতার বলয়, লুটের সংস্কৃতি ও প্রতিহিংসার দহন সেই স্বপ্নকে ছাই করে দিল।
টলস্টয় বলেছিলেন—”প্রতিটি বিপ্লবই চায় ন্যায়, কিন্তু পুরোনো শৃঙ্খল ছিঁড়তে না পারলে মানুষ নতুন শৃঙ্খলেই বন্দী হয়।”
২০২৪-এর বিপ্লবও তাই হলো—নতুন শৃঙ্খলের বন্দিত্ব, পুরোনো অন্যায়ের পুনর্জন্ম।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা
- ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধ—ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের অঙ্গীকার
- ১৯৭৪: দুর্ভিক্ষ—অব্যবস্থাপনা ও লুটতন্ত্রের দগ্ধ চিত্র
- ১৯৭৫: রক্তাক্ত অভ্যুত্থান—স্বপ্নভঙ্গের প্রথম নিষ্ঠুর আঘাত
- ১৯৮০-এর দশক: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় মুক্তির লড়াই
- ১৯৯০: গণঅভ্যুত্থান—গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি
- ২০০৬–০৮: তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন—নির্বাচনী ন্যায়ের সংগ্রাম
- ২০২৪: জুলাই–আগস্টের বিপ্লব—দশকের পর দশক ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ
প্রতিটি সময়েই জনতার অগ্নিগর্ভ প্রতিরোধ নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে, কিন্তু কাফকার ভাষায়—”বিপ্লবের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, সেটি অচিরেই রুটিনে পরিণত হয়।” বাংলাদেশের প্রতিটি বিপ্লবও তাই হয়েছে—রুটিনমাফিক ক্ষমতার লড়াই, মৌলিক পরিবর্তনের ব্যর্থতা।
কেন ইতিহাসের পাঠ থেকে আমরা শিখি নাঃ
দলীয় অন্ধকার: আন্দোলন হয় ক্ষমতার জন্য, ন্যায়ের জন্য নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতা: বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন, দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো দুর্বল ও দলীয়কৃত।
জাতীয় ঐক্যের অভাব: দলীয় আনুগত্য জাতীয় স্বার্থকে গ্রাস করে।
সংস্কারহীন সংগ্রাম: শাসক বদলালেও শোষণের কাঠামো অটুট থাকে।
ফরাসি দার্শনিক ফুকো বলেছিলেন—”শক্তি কেবল রাষ্ট্রে নয়, আমাদের প্রতিদিনের আচরণে বাসা বাঁধে।” আমরা সেই শক্তির শৃঙ্খল ভাঙতে পারিনি; তাই আন্দোলন কেবল শাসক বদলায়, অন্যায় ও শোষণ অক্ষত থাকে।
দর্শনের আলোকে মৌলিক পরিবর্তনের পথঃ
রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর: নীৎশের ভাষায়—“মানুষকে ক্ষমতার পিপাসা থেকে মুক্ত করে ‘সেবার মানুষ’ বানাতে হবে।”রাজনীতিকে লুটের আধার থেকে সেবার মঞ্চে রূপান্তর করতে হবে।
ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি: গ্রামসি বলেন—“অর্থনৈতিক ন্যায় ছাড়া কোনো গণতন্ত্র টিকে না।”লুটের অর্থনীতি ভেঙে জনগণের জন্য সম্পদের ন্যায়বন্টন নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ: ফ্যানন যেমন বলেছিলেন—“দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইলে মনের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে।”মুক্ত মনের শিক্ষা ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।
আইনের শাসন ও বিচারস্বাধীনতা: কান্টের মতে—“ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করলে স্বাধীনতা কেবল ভ্রান্ত ধারণা।”দলীয় প্রভাবমুক্ত শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা ছাড়া মুক্তি অসম্ভব।
জাতীয় ঐক্য: জন রলসের ন্যায়তত্ত্ব বলে—“সমাজকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে সবচেয়ে দুর্বল মানুষও ন্যায়বিচারের নিরাপত্তা পায়।”দলীয় বিভাজন ভেঙে সর্বজনীন মানবিক রাষ্ট্র গঠন জরুরি।
নতুন ইতিহাস লেখার ডাকঃ
২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই–আগস্ট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—আমরা অতীত থেকে শিখিনি।
কিন্তু এখনো সময় আছে।
আমাদের দরকার হেগেলের হতাশা অতিক্রম করা, সক্রেটিসের প্রশ্নমুখর সাহস, টলস্টয়ের অহিংস ন্যায়ের অনুসন্ধান, ফ্যাননের মুক্তির চেতনা, রলসের ন্যায়বোধ এবং নীৎশের সেবার দর্শন।
আমরা যদি এ দর্শনকে কর্মে রূপ দিতে পারি, তবে লিখতে পারব এক নতুন ইতিহাস—একটি ইতিহাস যেখানে সংগ্রাম রক্তে শেষ হয় না; বরং ন্যায়, সমতা ও মানবিক মর্যাদায় পরিণত হয়। একটি বাংলাদেশ, যেখানে বিপ্লব মানে কেবল শাসক পরিবর্তন নয়, বরং মানুষের প্রকৃত মুক্তি।
