বিশ্ব বিপ্লবের হৃদস্পন্দনঃ চে গুয়েভারা

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন।।
১৪ জুন, ১৯২৮—আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে জন্ম নেন এক শিশু, যার নাম ছিল এরনেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না। তখন কেউ জানত না, এই শিশুর নাম একদিন হবে পৃথিবীর শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতিরোধের প্রতীক। বিশ্ব তাঁকে চিনেছে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিস্ফোরক নামে—চে।
এই ‘চে’ কেবল একটি নাম নয়, এটি একটি অবস্থান, একটি অগ্নিশিখা। একটি নিঃশব্দ কিন্তু দৃপ্ত শপথ—’অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবো না, বরং লড়াই করবো যতক্ষণ প্রাণ থাকে।’
চে ছিলেন একজন চিকিৎসক। একজন মানুষের যন্ত্রণানাশক হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শিগগিরই তিনি উপলব্ধি করলেন—যে সমাজ মানুষকে দিনশেষে ক্ষুধার্ত রাখে, তাকে শুধু ওষুধ দিয়ে আরোগ্য করা যায় না। তাঁর হাতের এক পাশে ছিল চিকিৎসাবিদ্যার বই, আর অন্য পাশে বিপ্লবের অস্ত্র।
চে’র জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে মোটরসাইকেলে পুরো ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। এই যাত্রায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন দারিদ্রতা, বৈষম্য ও বঞ্চনার নগ্ন রূপ। মানুষের মুখে ক্ষুধার ছাপ, চোখে শোষণের বেদনা। সেই দগদগে অভিজ্ঞতা তাঁর হৃদয়ে জন্ম দেয় বিদ্রোহ, এবং সেই বিদ্রোহ একদিন পরিণত হয় বিপ্লবে।
চে শুধু কিউবার বিপ্লবের নায়ক নন—তিনি সিয়েরা মাস্ত্রার গেরিলা ঘাঁটির অনন্য সাহসী কমান্ডার, ফিদেল কাস্ত্রোর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। কিউবায় ফুলি‌জেনসিও বাতিস্তার শোষণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল বজ্রের মতো তীব্র এবং অপ্রতিরোধ্য।
তবে চে থেমে থাকেননি কিউবার সীমান্তে। তাঁর চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনামের জঙ্গলে, কঙ্গোর রক্তাক্ত ভূখণ্ডে, এমনকি আজকের ফিলিস্তিনের নির্যাতিত চোখের কান্নায়ও যেন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
চে বলেছিলেন—’আমরা যেন একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অন্য একটি অন্যায়ের সহায়ক না হই।’ এই কথায় ফুটে ওঠে তাঁর নৈতিক দৃঢ়তা, রাজনৈতিক সততা এবং মানবিক স্পর্শ।
চে জানতেন, বিপ্লবের পথ মৃত্যুতে গিয়ে থেমে যেতে পারে। তবু তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন বলিভিয়ার দুর্গম জঙ্গলে। তাঁর বিশ্বাস ছিল—’বিপ্লব একটি সংক্রমণ। একে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না।’ তাঁকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি বলেন:’আমি জানি, তুমি আমাকে হত্যা করবে। গুলি করো। কিন্তু মনে রেখো, তুমি একজন মানুষকে মারছো, আদর্শকে নয়।’
এই উচ্চারণ আজো পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ধ্বনিত হয়। চে আমাদের দেখিয়ে গেছেন—বিপ্লবীর শরীর মরে যেতে পারে, কিন্তু তার আদর্শ অমর।
আজ চে কোথায়?
তিনি নেই কোনো রাজপ্রাসাদে, নেই কোনো ক্ষমতার অলিন্দে। তবুও তিনি আছেন সেই তরুণের শ্লোগানে—
“ভিভা লা রেভোলুশন!”
তিনি আছেন গার্মেন্ট শ্রমিকের নিঃশব্দ ঘামে, কিংবা কৃষকের মাটির গন্ধে।
তিনি আছেন পৃথিবীর দেশে দেশে অলিতে গলিতে আঁকা সেই ছবিতে, যেখানে একটি চাহনি বলে দেয় ‘প্রতিরোধ করো, মাথা নত করোনা।’
চে আজও বেঁচে আছেন।
পোস্টারে, কবিতায়, গানে এবং সবচেয়ে বড় কথা—অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কোনো যুবকের ধমনিতে। চে এখন আর কেবল মার্কসবাদী দর্শনের অংশ নন। তিনি এক অনুভবের নাম। তাঁকে বোঝা যায় না কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে—তাঁকে জানতে হয় ক্ষুধার্ত শিশুর চোখে, নির্যাতিত জনতার দৃষ্টিতে।
চে ছিলেন না কেবল সমাজতন্ত্রী, গেরিলা, কিংবা রাজনীতিক। তিনি ছিলেন মানবতার পক্ষে এক অদম্য জাগরণ। একটি নির্লোভ, নির্ভীক, বিপ্লবী হৃদয়ের নিঃশব্দ আগুন।
১৪ জুন তাঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর মৃত্যু নেই।
চে বেঁচে আছেন—যেখানে অন্যায় আছে, সেখানেই একটি ঠোঁটচাপা শ্লোগানে, একটি অগ্নিময় চোখের দৃষ্টিতে—
চে লিভস অন!
ভিভা লা রেভোলুশন!
আরো পড়ুন