দাম্ভিক নেতাদের দম্ভ চূর্ণ হবেই

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ইতিহাস নিছক স্মৃতির দলিল নয়, এটি এক একটি জীবন্ত আয়না—যেখানে প্রতিফলিত হয় মানুষের অহংকার, ক্ষমতার লালসা এবং তার অনিবার্য পতনের করুণ দৃশ্যপট। রাজা হোক কিংবা রাষ্ট্রনায়ক—ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছেও যারা বাস্তবতা বিস্মৃত হন, মানবতার ধ্বনি উপেক্ষা করে একচ্ছত্র দম্ভে আত্মমগ্ন থাকেন—তাদের কাহিনী শেষ হয় নির্বাক নীরবতায়, ধ্বংসস্তূপে কিংবা জনরোষে। ইতিহাস বারবার এই কথাটাই বলে—দাম্ভিকদের দম্ভ চূর্ণ হবেই।
রানী ভিক্টোরিয়ার (১৮১৯–১৯০১) শাসনকাল ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শীর্ষ সময়। ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যায় না’—এই অহংকার একসময় গোটা দুনিয়াকে গ্রাস করেছিল। উপনিবেশের জঞ্জাল ছড়িয়ে ব্রিটিশরা বিশ্বজুড়ে নির্মাণ করেছিল দম্ভের সাম্রাজ্য। অথচ আজ সেই সাম্রাজ্য কোথায়? অতীতের গৌরবগাথা এখন আর শুধু যাদুঘরের প্রদর্শনী কিংবা শিক্ষাপুস্তকের বিবরণ। ব্রিটেনের সেই দম্ভ আজ অতীতের ধূলায় মিশে গেছে।
তেমনি একসময় বলশেভিক বিপ্লবের আওয়াজ ছিল ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় বিশ্বজোড়া পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি। নিপীড়িত মানুষের মুক্তি, সাম্য ও শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল লাল পতাকার ছায়ায়। কিন্তু সেই স্বপ্নও ক্ষমতার দম্ভে, চরম বস্তুনির্ভর আদর্শবাদে, আর জনগণ বিচ্ছিন্ন একনায়কতন্ত্রে রূপ নিয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যেন এক অনিবার্য পরিণতির নাম।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯–১৮২১) ছিলেন এক বিস্ময়কর চরিত্র। যিনি যুদ্ধ জয় করে ইউরোপকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি ঘৃণা করেছিলেন ব্রিটিশদের, বলতেন ‘তারা কেবল দোকানদার’। অথচ ভাগ্য কত নির্মম! সেই ব্রিটিশদের হাতেই ওয়াটারলুতে তার পতন ঘটে। শেষ জীবনে তিনি বন্দী, অবরুদ্ধ, পরাজিত। তার পরিণতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন সংযম হারায়, নেতৃত্ব তখন অহংকারে বিষাক্ত হয়।
আর ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়—এডলফ হিটলার (১৮৮৯–১৯৪৫)। তার মন্ত্রমুগ্ধকারী ভাষণ, জাতীয়তাবাদের উত্তাপ, কল্পিত শ্রেষ্ঠ জাতি গড়ার দম্ভ—এসবই একসময় বিশ্বযুদ্ধ, গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধে পরিণত হয়েছিল। হিটলার নিজেই হয়ে ওঠেন এক দানব, যিনি মানুষ নয়, ইতিহাসের হৃদয় কেঁপে ওঠা এক দুঃস্বপ্ন। পরিণতিতে তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়।
আজকের বিশ্বে আমেরিকা বহুপাক্ষিকতার বদলে এককেন্দ্রিক নীতিতে ঝুঁকে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতৃত্ব সেই বিপজ্জনক প্রবণতাকে আরও উস্কে দেয়। তিনি অভিবাসীদের অপমান করেছেন, ভিন্নমতের মানুষকে জাতির ‘শত্রু’ ঘোষণা করেছেন, সমাজে বিভক্তির রেখা টেনেছেন ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’ বলে। এসব দম্ভের বীজ কখনোই সুস্থ সমাজে শান্তির ফুল ফোটায় না, বরং সঞ্চার করে ঘৃণা, বিভ্রান্তি এবং গণঅসন্তোষ।
গণতন্ত্রের জনক প্লেটো এমন নেতাদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন—“যারা কেবল মিষ্টি কথায় ও কৌশলে ক্ষমতায় আসে, তারা একদিন স্বৈরাচারে রূপ নেয়।” ট্রাম্প বা তাঁর মতো নেতৃত্ব সেই দম্ভেরই আধুনিক প্রতিরূপ। এসব উদাহরণ শুধু রাজনৈতিক নয়, এগুলো দর্শনেরও পাঠ—ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে তোলে, যদি না থাকে মানবতা, আত্মসমালোচনা আর সহনশীলতার চেতনা।
আসলে দম্ভ কখনোই মানুষের গুণ নয়; এটি আত্মধ্বংসের প্রস্তাবনা। ইতিহাস নীরবে এসব উগ্র, আত্মমগ্ন নেতাদের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের দিনলিপি লিপিবদ্ধ করে চলে—যার শেষ হয় প্রাসাদ নয়, প্রাচীর ভাঙার ধ্বনিতে। জনগণের হৃদয়ে যারা স্থান পায় না, তারা কাগজে-কলমে নেতা হলেও প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাহীনই থাকে।
আমাদের এই সময়েও যেসব নেতা ইতিহাসকে উপেক্ষা করে, মানবিকতা বিস্মৃত হয়ে বিভাজন ও দম্ভের রাজনীতি করছেন, তারা যেন না ভোলেন—এটিই ইতিহাসের ধ্রুব সত্য:
দাম্ভিক নেতাদের দম্ভ চূর্ণ হবেই।
দম্ভের স্থায়িত্ব নেই—মানবতার আছে, ঐক্যের আছে, সত্যের আছে। আর ইতিহাস সবকিছুর বিচারক হয়ে চুপিচুপি ঘোষণা করে দেয়—পতন ঘটবেই, যদি অহংকার জাগে হৃদয়ে।
inside post
আরো পড়ুন