ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আজও ভেসে আসে উষ্ণ বাতাস—যা শুধু আবহাওয়ার নয়, ইতিহাসের, রাজনীতির, এবং ভ্রাতৃত্বের নামে এক অব্যক্ত কূটচালের। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী রাজনৈতিক মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়—বড় রাষ্ট্রের প্রভাব কেবল সাহায্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং একপ্রকার ‘নরম আগ্রাসন’ বা soft annexation-এর কৌশলে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক মানসপটে আজও “সপ্তভগিনী” তত্ত্বের ছায়া প্রকট। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরাকে একত্রে বলা হয় “Seven Sisters”। এই ভৌগোলিক অঞ্চলটি একদিকে যেমন বিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে তেমনি সাংস্কৃতিকভাবে ভারতবর্ষের মূলধারার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে ভারত এই অঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে রাখতে চাইছে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে। এ কৌশলের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ: সপ্তভগিনীর “অষ্টম” স্বপ্ন?
বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে ভারত যে ভূরাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছিল, তা অনেকটাই ছিল কৌশলগত (Rudra Chaudhuri, Forged in Crisis, 2014)। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি ভারতের অনেকেই মনে করেছিল—বাংলাদেশ এক প্রকার “সাংস্কৃতিক প্রদেশ” হয়ে উঠতে পারে, যা পরবর্তীতে ‘অষ্টম ভগিনী’ তত্ত্বের জন্ম দেয়। এই ধারণা কোনো রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় না থাকলেও, ভারতীয় মিডিয়া ও নীতিনির্ধারকদের আচরণে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।
ভারতের অতীত দৃষ্টান্ত: হায়দ্রাবাদ ও সিকিম দখল
ভারতের ইউনিয়ন গঠনের পরেও কিছু স্বাধীন রাষ্ট্র নিজস্ব পরিচয়ে থাকতে চেয়েছিল। হায়দ্রাবাদ (তৎকালীন নিজাম শাসিত) ছিল একটি সমৃদ্ধ ও স্বাধীন মুসলিম রাজ্য, যাকে ১৯৪৮ সালে “অপারেশন পোলো”-র মাধ্যমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি ছিল একটি একতরফা সামরিক অভিযান (Refer: Ramachandra Guha, India After Gandhi, 2007)।
একই রকমভাবে, হিমালয় কন্যা সিকিম—যেটি ৮৪ বছর ধরে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল—তাকে ১৯৭৫ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তবে ঐ গণভোট নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও অভিযোগ ছিল যে সেটি ছিল ভারতের চাপে পরিচালিত এবং একতরফাভাবে সংহতি আরোপের একটি প্রকল্প (Refer: Sunanda K. Datta-Ray, Smash and Grab: Annexation of Sikkim, 1984)।
চিকেন নেক: ভারতের দুর্বলতম কৌশলগত স্থান
ভারতের সবচেয়ে বড় কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে পরিচিত ‘চিকেন নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডোর (২২ কিমি প্রশস্ত একটি করিডোর), যেটি মূল ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে রেখেছে। যদি কোনো প্রতিকূল শক্তি এই করিডোর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তাহলে ভারতের সাতটি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে (Refer: Brahma Chellaney, Asian Juggernaut, 2010)। বাংলাদেশ ভূ-অবস্থানগতভাবে এই করিডোরের খুব কাছেই অবস্থান করছে, তাই দিল্লির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হলো এক ‘জিওস্ট্র্যাটেজিক বাফার স্টেট’। ফলে ভারতের একটি গোপন ভয় সবসময়ই সক্রিয় থাকে—বাংলাদেশ যদি চীন, তুরস্ক, বা আরব বিশ্বের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তোলে, তাহলে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় নকশায় ফাটল ধরবে।
বন্ধুত্ব না আধিপত্য?
ভারত সহযোগী রাষ্ট্রের মুখোশে বাংলাদেশের ওপর একপ্রকার সাংস্কৃতিক আধিপত্য আরোপ করতে চায়—যা শুধু বলিউড কিংবা বিনিয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব, মিডিয়া হস্তক্ষেপ এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতামতের মাধ্যমে স্পষ্ট। একদিকে ভ্রাতৃত্বের বুলি, অন্যদিকে সীমান্তে গুলি, নদীপ্রবাহে একতরফা বাঁধ নির্মাণ কিংবা বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা—এই দ্বিচারিতা বন্ধুত্বের প্রতীক নয়, বরং আধিপত্যের ইঙ্গিত।
‘পরবাসী’ মেয়ের ডাক
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর বিখ্যাত সংগীতে উচ্চারণ করেছিলেন—
“কেন ঘরের ছেলে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে?”
আজকের প্রশ্ন একটু বদলে বলা যেতেই পারে—
“কেন ঘরের মেয়ে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে?”
বাংলাদেশ কারো ‘ভগিনী’ নয়, কারো উপনিবেশও নয়। বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড—যার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও মানসিকতা কারো অনুসারী নয়।
ইতিহাসকে বিকৃত নয়, বুঝতে হবে
ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশকে বন্ধু, প্রতিবেশী এবং একটি সমান মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে শেখা। উপমহাদেশে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতা নয়, চাই সম্মান ও সংহতির রাজনীতি। ভূগোলের পাশাপাশি ইতিহাসও যেন বলে—“জয় হোক মানুষের, জয় হোক সত্যের।” রাজনীতির দাবা খেলায় রাষ্ট্র যদি মাত্রা হারায়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শুধু জনগণ—আর তারা কোনো দলীয় ছাতার নিচে আশ্রয় খোঁজে না, খোঁজে নিজের ঘরের স্বাধীন আকাশ।
প্রামাণ্য রেফারেন্স:
Ramachandra Guha, India After Gandhi (2007)
Sunanda K. Datta-Ray, Smash and Grab: Annexation of Sikkim (1984)
Rudra Chaudhuri, Forged in Crisis (2014)
Brahma Chellaney, Asian Juggernaut (2010)
inside post
আরো পড়ুন