স্মৃতির আয়নায় শৈশবের কাব্যিক ঈদ

 

inside post

মনোয়ার হোসেন রতন।।

শৈশব মানেই এক রঙিন কল্পনার জগত, যেখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি উৎসব, ছিল একেকটি রূপকথার মতো। সেই কল্পনার জগতে ঈদুল আযহা ছিল আমাদের হৃদয়ের কাব্যের এক অনন্য উচ্চারণ। আশির দশকে বেড়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের কাছে ঈদের মানেই ছিল এক অন্তহীন অপেক্ষার প্রাপ্তি, খোলা মাঠে ছুটে বেড়ানোর মুক্তি, আর পারিবারিক বন্ধনের উষ্ণ অনুভব।
আজকাল ঈদের দুই-একদিন আগে গরু কেনা হয়, শহুরে ব্যস্ততায় সব যেন নিয়মে বাঁধা। কিন্তু তখন? তখন তো ঈদের চেয়ে ঈদের আগের দিনগুলোতেই আনন্দ ছিল বেশি! গরু কেনা হতো প্রায় সাত থেকে দশ দিন আগে। বাবার সাথে গরুর হাটে যাবার আবদার করতাম বারবার, কিন্তু বাবা আমাদের নিয়ে যেতে চাইতেন না। তার বদলে নিয়ে যেতেন আমাদের শ্রদ্ধেয় মেজ ভাই মোয়াজ্জেম হোসেনকে। তখন মনের মাঝে একরাশ অভিমান, আর ভাইয়ার প্রতি ঈর্ষামিশ্রিত ভালোবাসা।
গরু কিনে ফিরলে যেন সবার চোখে এক বিজয়োল্লাস। গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ত খবর-“ওদের বাড়িতে গরু এসেছে!” তারপর শুরু হতো গরুর চারপাশে ঘোরাঘুরি। আমরা গরুর নাম রাখতাম, কখনো আবার আনোয়ার ভাইয়ের দেয়া নামে গরুর নাম হয়ে যেত, বলতেন “গরুরও তো একটা পরিচয় দরকার!” সেই পরিচয়ের পেছনে ছিল আদর, খেয়াল আর একরাশ কল্পনা।
মেজভাই মোয়াজ্জেম হোসেন হয়ে উঠতেন এক নির্ভরতার প্রতীক। ঠিক যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, গরুকে নিয়ে মাঠে ছুটতেন, আর আমরা ছুটতাম তার পেছনে পেছনে। মাঠ তখন আমাদের রাজ্য, গরুর পেছনে দৌড়, খেলা, ধুলোয় মাখামাখি শরীর, আর ঘামে ভেজা দুপুর,সব মিলিয়ে ঈদের আগমনী সুর বেজে উঠত হৃদয়ে।
গরুকে গোসল করানো, খাবার খাওয়ানো, মাথায় হাত বুলানো,সবকিছুতেই ছিল আমাদের অপার আনন্দ। মানিক ভাইয়ের হাতে একবার গরু দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল মাঠের শেষ প্রান্তে, আমরা ছুটেছিলাম তার পেছনে হাসতে হাসতে। সেই হাসি আজো কানে বাজে। আনোয়ার ভাই ছিলেন একেবারে ভিন্নরকম। তিনি গরুর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বলতেন,”এটা কিন্তু আমাদের অতিথি, যতেœ রাখো।”তার মমতা আর রসবোধে ঈদের রঙ আরও গাঢ় হতো।
ঈদের আগের দিন রাতে রুমাল গুঁজে রাখতাম জামার পকেটে, যেন কোরবানির দিন মাংস রাখার ঝামেলা না হয়। মা বলতেন, “মাংস কাঁধে নিয়া খেলতে যাইস না, ঠান্ডা লাগব।”কিন্তু কে শোনে কার কথা! মাংস কেটে ছোট ছোট পিস করতাম, কার কোন অংশ কে পাবে তা নিয়ে চলত তর্ক। বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক টুকরো মাংস মুখে পুরে ফেলতাম,স্বাদ যেন ঈদের স্বর্গ।

ঈদের দিনে সকালবেলা নতুন জামা পরে ঈদগাহে যাওয়া, বাবা আর ভাইদের সাথে মিলেমিশে কোরবানির কাজ শুরু করা, চারপাশে রক্ত, ধোঁয়া আর তবুও মনের মধ্যে এক অনির্বচনীয় আনন্দ। কে কত সাহসী,এই নিয়েও চলত প্রতিযোগিতা। কেউ বলত, “আমি গরুর সামনে দাঁড়াইছি”, কেউ বা বলত,”আমি ধরে রাখছিলাম মাথা”! সেই সাহস ছিল শৈশবের সারল্যে ভরপুর, ভীতু হৃদয়ে সাহসী চেহারার রঙ মাখানো।
ঈদের পরের দিনগুলো ছিল মাংস বিলি-বন্টনের গল্প। কার ঘরে কী রান্না হলো, কে কেমন খাওয়াল-এই সব গল্প চলত রাস্তায়, উঠানে, বারান্দায়। মা রান্না করতেন স্নেহ মিশানো ভুনা মাংস, যার ঘ্রাণেই মন ছুটে যেত শিশুকালের মাঠে। পাড়া-প্রতিবেশীরা একে অপরের বাড়িতে মাংস পাঠাতেন, আর সেই আদান-প্রদানে তৈরি হতো সম্পর্কের সেতু। আজ তা অনেকটাই ক্ষীণ-দেওয়া পাওয়া অনেকটাই ফেসবুক পোস্টের ভিতর সীমাবদ্ধ।
সেই শৈশবের ঈদ ছিল কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, ছিল এক আবেগঘন পারিবারিক মিলনের নাম। মেজ ভাই, আনোয়ার ভাই, মানিক ভাই, আপা হোসনে আক্তার, বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন মজনু তাঁদের সান্নিধ্যেই ঈদের রূপ ছিল পরিপূর্ণ। আজ তারা কেউ কর্মব্যস্ত, কেউ দূরে, কেউ স্মৃতির পাতায় স্থির হয়ে আছে।
সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, শহর গ্রাস করেছে খোলা মাঠ, কিন্তু স্মৃতির আয়নায় আজও সেই ঈদগুলোর প্রতিচ্ছবি ঝিকমিক করে। সেসব দিন, সেসব মানুষ, আর সেই নির্ভেজাল আনন্দ-সব মিলিয়ে এক কাব্যিক ঈদ, যাকে কখনোই ভুলে থাকা যায় না।
লেখক:কবি ও কলাম লেখক।

আরো পড়ুন