বিসর্জন — আজ বিজয়া দশমী।

 

অনেক কাজ। অনেক ব্যস্ততা অভিদের। অভি মানে অভিজিৎ দত্ত। অভি এই পাড়ার তরুণ-তরুণীদের লিডার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অর্থনীতি বিভাগে তৃতীয় বর্ষ। শুধু তাই নয়, এই পাড়ার পুজো কমিটির সেই এখন প্রধান মানে সভাপতি। গতবছর পর্যন্ত সমি তথা সৌমিত্র দেব ছিল সভাপতি, সে ছিল সহসভাপতি। সমি এখন অন্য জেলায় থাকে। যদিও এই পাড়াতেই জন্ম, বড় হওয়া, পড়ালেখার শুরু। কিন্তু যেকোনো কারণে তাকে চলে যেতে হয়েছে। না তাকে কেউ বাধ্য করেনি। কিন্তু সে নিজে থেকেই একদিন চলে গেছে এই পাড়া, এই শহর এবং শৈশবের বন্ধু-বান্ধবী ও পিসিমাকে ছেড়ে। অধ্যাপিকা পিসিই তার অভিভাবক, কারণ জন্মলগ্ন থেকে মাহারা সমি। দুবছর বয়সে সমির বাবাও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সমি নম্র, ভদ্র, সদয় এবং মেধাবী একটি ছেলে।

গত একটি বছর ধরে বন্ধু তথা অভিদের মনে আনন্দ নেই, প্রাণচঞ্চল্যও নেই। তবু পৃথিবী তো থেমে থাকতে পারে না, তার চলমান চাকার সঙ্গে মানুষের জীবন বাঁধা। মানুষ একসঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলেও পৃথিবীর ওই চাকাই তাকে টেনে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পৃথিবীর এটাই অমোঘ নিয়ম।

গত এক বছরে দুবার মাত্র দেখা হয়েছে সমির সঙ্গে অভিদের। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা দশ-বারো জন বন্ধু-বান্ধবী ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা কলেজ আর মহিলা কলেজের ছাত্রছাত্রী ছিল। বিগত বছর তিনেক ধরে তারা কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে। কিন্তু গত দুবছর তারা সময়সুযোগ করে আপন শহরে ফিরে এসেছে। হৈ হল্লায় মেতে উঠেছে, পিকনিক করেছে বাদল মামার পুরনো বাড়ির পাশের খোলা প্রাঙ্গণে। সেখানে নরোম ঘাসের কার্পেট বিছানো। শীতের সময় চেয়ার পেতে আড্ডায় মশগুল হয়েছে। বাদলমামার বোন সুধামাসি বড় একটি ফ্ল্যাক্সে করে চা আর বিস্কুট পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাদলমামা ও সুধামাসি এপাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ এবং ছেলেমেয়ে সকলের কমন মামা ও মাসি। বাদলমামা বিয়ে করেননি, জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেট খেলা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। আর তার পিঠোপিঠি বোন সুধার স্বামী অনেক আগে গত হয়েছেন, এক ছেলে থাকে বিদেশে আর ছোট মেয়ে থাকে স্বামীর সঙ্গে সিলেটের চাবাগানে। চায়ের ব্যবসা জামাইয়ের। মেয়েটা মাঝেমাঝে আসে মার কাছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে, তারাও বড় হয়ে গেছে। সুধামাসির মেয়ে সুভদ্রা অভিদের কমন দিদি। যেমন সুন্দরী, তেমনি দীর্ঘাঙ্গী এবং সুঠাম দেহের অধিকারী—একবার দেখলে চোখ ফেরানো কঠিন। দুর্গা পুজোর সময় তো তাকে আসতেই হয়। কারণ এই পাড়ায় যে পুজো হয় এই বাড়িতেই শুধু। কত বড় বাড়ি এবং চারদিকে খোলা জায়গা! শোনা যায় তারা কোনোকালে জমিদার ছিলেন ত্রিপুরার কোনো এক পরগনার। তাই চালচলনে, আচারআচরণে, কথাবার্তায়, কাজেকর্মে আভিজাত্য লক্ষণীয়। বিগত সত্তর বছর ধরে এই বাড়িতে পুজো হচ্ছে। নন্দীবাড়ির পুজো আলোড়ন সৃষ্টিকারী পুজো। জমজমাট হয় দুর্গা ও সরস্বতী পুজো। এবারও হচ্ছে ওই খোলা প্রাঙ্গণে। পুজো উপলক্ষে জড়ো হয়েছে বন্ধু-বান্ধবী সবাই। শুধু দুজন নেই সমি ও উপলা। সমি স্বনির্বাসিত আর উপলা গৃহবন্দি। পুজোর পরেই উপলার বিয়ে।

এই পাড়ার পুজোর মূল উদ্যোক্তা বাদলমামারাই। অধিকাংশ অর্থই তারা দেন, বাকিটা পাড়ার হিন্দু এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই শহরে এখনো বেশ কিছু বনেদী হিন্দু পরিবার রয়েছে যাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। চলে গেছে অনেক পরিবার পয়ষট্টি সালের আগে ও পরে। ওই বছর পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গেছেন তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ধনী পরিবার আর ফেরেনি। নন্দীবাড়ির পুজোতে হিন্দু ব্যসায়ীরা স্বেচ্ছায় চাঁদা দিয়ে থাকেন। আর চাঁদা সংগ্রহ করে থাকে অভিরা ‘উত্তরণ সংঘে’র পক্ষ থেকে। বাদলমামার পরিবারই এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। বয়স অনুসারে তরুণরাই এর কার্যকারী সদস্য হয়ে থাকে আর বয়স্করা উপদেষ্টা বা বিশেষ সদস্য, এই নিয়মই চলে আসছে। নিয়ম অনুযায়ী সমি সভাপতি হয়েছিল কলেজে ওঠার পরপরই। পাঁচ বছরের জন্য। সেক্রেটারি হয়েছে মৃণাল সূত্রধর তথা মৃন্ময়।
কিন্তু এবারের পুজোয় সবাই আনন্দ করলেও অভিদের মনে প্রাণ নেই বললেই চলে। যেন পুজো করতে হচ্ছে তাই করছে। স্বতঃস্ফূর্ততা একেবারেই নেই। মূল কারণই হল সমির অনুপস্থিতি। কেন এপাড়া ছেড়ে চলে গেল সমি তারা সবাই জানে? শুধু তারাই নয়, অনেকেই জানে। সমির কী দোষ ছিল? কী অন্যায় সে করেছিল যে তাকে অভিমান করে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে দূরের অন্য কোনো জেলায়? তাতে করে কোনো লাভ হয়েছে কারো? অভি ক্ষুদ্ধ, মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে সমির উপর নয়, উপলার বাবা-মার উপর। সমি-উপলার প্রেম বা সম্পর্ক তো নতুন কিছু নয়! সেই স্কুলজীবন থেকে। এরকম কি হরদম হচ্ছে না পৃথিবী জুড়ে! এই সমাজ কবে জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে একমাত্র ঈশ্বরই জানে!

অভি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃন্ময়কে বলল, ‘আজ অনেক কাজ। প্রতিমা বিসর্জন দিতে হবে মধ্যরাতে। সবাই তো ক্লান্ত বুঝতে পারছি কিন্তু এখনো কেউ আসছে না যে! বাজারে যেতে হবে। কাটাকুটি, রান্নাবান্না, সাজানো-গোছানো নানা কাজ! সমি থাকলে অনেক কাজ সে একাই করে ফেলতে পারত। আজ মনটা কেমন যেন করছেরে সকাল থেকে! একদম ভালো লাগছে না!’

মৃন্ময় গত রাতের জমে থাকা ছাইয়ের স্তুপ, পোড়া নারকেলের ছোবড়া, বাসি জল, পাতালতা একটি বড় প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘এত বড় একটি পুজো! এত আয়োজন! অত খাটাখাটুনি, ক্লান্ত না হয়ে উপায় আছে! অত চিন্তা করিস না, সবাই সময়মতো চলে আসবে। মাত্র তো সকাল ন’টা বাজে।’ মৃন্ময়ের কথা শেষ না হতেই সদয়, নির্মল আর কেয়া চলে এসেছে। কেয়া ঝাড়ু নিয়ে এসেছে, প্যান্ডেলের চারপাশ জুড়ে অজস্র টুকরো কাগজ আর ঝরাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো ঝাড়ু দিয়ে ঝেঁটিয়ে একজায়গায় জড়ো করতে লেগে গেল।

সদয় বলল, ‘অভি, পান্নাদার দোকান থেকে কিছু খেয়ে আসি ভীষণ খিদে পেয়েছে! তোদের জন্যও নিয়ে আসব কিছু?’
অভি বলল, ‘তাই কর। গত দুদিনের টাকাও দেয়া হয়নি। আজকেরটাসহ টোটাল বিল নিয়ে আসিস। আগামীকাল ফান্ড থেকে পরিশোধ করব।’ সদয় যেতে যেতে হাত তুলে সায় দিল।

অভি একটা সিগারেট ধরিয়ে হাতের আড়ালে লুকিয়ে দুটান দিয়ে বলল, ‘কেয়া শোন! কিছু জরুরি কথা আছে। এদিকে আয়।’ বলে অভি প্যান্ডেলের পেছনে গেল। কেয়া এসে বলল, ‘কী কথা বল্?’

অভি সিগারেটে দু-তিন টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল,‘শোন্! একটা কাজ করতে হবে। খুব জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ।’
কেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,‘কী কাজ বলবি তো! না বললে বুঝব কী করে?’

—‘বলছি! বলছি! গতকাল সমি ফোন করেছিল বাসায় গভীর রাতে। ও আজকে আসবে। উপলাকে একটিবার দেখার জন্য। কিছু কথাও বলতে চায়। আজই কিন্তু শেষ সুযোগ। কারণ পুজোর পরপরই উপলার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। হলুদকোটাও হয়ে গেছে, জানিস তো? বিয়ের পরই চলে যাবে আমেরিকায় বরের সঙ্গে। বর বিয়ে করার জন্যই দেশে ফিরেছে। সমি আমাকে এসব বলেছে কতকাল।’

অনেকটা বিস্ময় কেয়ার চোখেমুখে, ‘তাই নাকি! অতকিছু তো জানতাম না! সমিকে ডেকে নিয়ে বাড়িতে উপলার বাবা-মা খুব অপমান করেছেন সেটা জানতাম। বিয়ে হচ্ছে তাও জানি। কিন্তু বর যে আমেরিকায় থাকে তা জানতাম না! চলে গেলে আর এদেশে ফিরে আসবে মনে হয় না।’
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেয়া আবার মুখ খুলল, ‘এত বছরের সম্পর্কটা এভাবে ভেঙ্গে দিলেন তারা ভাবতে পারছি না! শুনেছি জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী রুদ্রপ্রসাদ উপাধ্যায় খাঁটি ব্রাহ্মণ! তাই মাটিতেই পা পড়ে না উপলাদের বাবার! অথচ উপলার একদম উন্নাসিকতা নেই! একেবারে জলকাদায় তৈরি মেয়েটা। কিন্তু ওর বড়দাও ওইরকম। কী কড়া মেজাজ! ওদের মা তো আরও দজ্জাল! কেয়া যা ভয় করে মাকে!…..এখন কী করব বল্?’

—‘সেটাই তোকে বলছি। সুধামাসির সঙ্গে আলাপ করেছি সমির সঙ্গে কথা বলার পর। উপলার মা, মানে মাসিমা এপাড়ায় একমাত্র সুধামাসিকেই মান্য করেন। পুজো দেখতে আসেন বিজয়া দশমীর দিন। এলে সুধামাসির সঙ্গে গল্পটল্প করেন কিছুক্ষণ। এবারও আসবেন। কিন্তু উপলাকে নিয়ে আসবেন কিনা জানি না। সুধামাসি আজকে দুপুরে যাবেন উপলাদের বাসায়। মাসিমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন সেইসঙ্গে উপলাকেও যেন নিয়ে আসেন সেই অনুরোধ করবেন। কারণ উপলার এটাই হয়ত শেষ পুজো দেখা। এতবছর ধরে পুজোর আয়োজনে কাজ করে এসেছে, এবারই করতে পারেনি। অন্ততপক্ষে, পুজোটা দেখে যাক! আবার কবে আসে না আসে! সন্ধেবেলা উপলাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার জন্য বলবেন সুধামাসি। আর যাই হোক, মাসিমা সুধামাসির অনুরোধ ফেলতে পারবেন না! আর এলেই হল! সুধামাসি ভুলিয়েভালিয়ে রাখবেন মাসিমাকে। এইফাঁকে তুই ইশারায় উপলাকে ডেকে নিয়ে বাড়ির পেছনে যে শিউলি আর স্বর্ণলতার ঝোঁপঝাড় আছে সেখানে নিয়ে যাবি। তিনদিকে উঁচু দেয়াল আছে, ঝোঁপঝাড়ও ঘন দেখাই যাবে না। তাছাড়া ওখানে আলোও নেই। ঠিক আছে? পারবি তো?’

—‘আচ্ছা।’ মাথা নেড়ে সায় দিল কেয়া।
অভি আরও বলল,‘মাসিমা টের পাওয়ার আগেই উপলাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবি। আমি পপি, ছবি আর পারমিতাকে গার্ড হিসেবে থাকার কথা বলব। নজর রাখবে মাসিমার ওপর। ঠিক আছেরে কেয়া? সমির জন্য এতটুকু যদি আমরা করতে না পারি মরেও শান্তি পাব না। তাই না?’
—‘সত্যিই তাই অভি। চিন্তা করিস না। আমি পপিদের সঙ্গে কথা বলে নেব। সমিকে দেখি না কতদিন হয়ে গেল! দেখা হলে খুব ভালো লাগবে!’ কেয়া দুচোখ মুছে নিল আঙুল দিয়ে।

চারটা বাজতেই জমে উঠতে শুরু করল প্যান্ডেল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কেউ বাদ নেই এই পাড়ার, সবাই চলে এসেছে। হৈ হল্লা, চেঁচামেচি, দৌড়োদৌড়ি করছে। পুলিশ এসে গেছে এক ট্রাক। নেমেই রাস্তা থেকে প্যান্ডেল পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছে। প্যান্ডেল পর্যন্ত রাস্তার মাঝখানে একাধিক খুঁটি গেড়ে দড়ি বেঁধে পুরুষ এবং মহিলাদের পথ আলাদা করা হয়েছে। মাইকে বাজছে ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা হিট গানগুলো একটার পর একটা। চারদিকে গুঞ্জনের মাত্রা বেড়েই উঠছে।

অভি ও তার বন্ধুরা সবাই নানা কাজে ব্যস্ত। আজ অনেক গেস্ট আসবেন শহর থেকে যারা নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তাছাড়া আত্মীয়স্বজন, অন্যপাড়ার বন্ধু-বান্ধবীরা তো আসবেই। মান্যবর অতিথিরা যাতে বসে পুজো দেখতে পারেন তার জন্য বাড়ির ছাদে অনেকগুলো চেয়ার আর টেবিল বসানো হয়েছে। তাদের জন্য প্রসাদ তৈরি করা হচ্ছে বড় রান্নাঘরে। ফলফসারি, নানা রকম ভাজি, লাবড়া আর মিষ্টান্নর মৌ মৌ গন্ধে পুরো এলাকার বাতাস ভারী হয়ে গেছে। সাধারণ ভক্তদের জন্য নারকেলের নাড়ু, তিসির নাড়ু আর পেড়াভর্তি প্যাকেট তৈরি করছে পাড়ার বৌ, ঝি আর বয়স্ক মহিলারা। এসব কাজের তত্ত্বাবধান করছে অভি আর মৃন্ময়।

সন্ধে হতেই প্যান্ডেলের চারদিকে মানুষ আর মানুষ! রিকশা, গাড়ির শব্দ, হৈচৈ, শিশ দেয়ার শব্দে কান পাতা দায়। মাঝেমাঝে বাজি পোড়াচ্ছে ছেলেরা। মণ্ডপের ভেতরে নানা রঙের আলো জ্বলছে নিভছে, সেই সঙ্গে ধুপের কুণ্ডুলিপাকানো ধোঁয়াও রঙিন হয়ে অদ্ভুত এক মায়াজাল সৃষ্টি করেছে। এবারে দুর্গা প্রতিমাসহ সব প্রতিমারই গঠন ও সাজসজ্জা এতই আকর্ষণীয় যে চোখ ফেরানো যায় না! এবার প্রতিযোগিতায় নন্দীবাড়ির পুজো প্রথম হবেই হবে, বলাবলি হচ্ছে শহরে। গত দুবছর হেরে গেছে। এবার পয়সাও খরচ হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। মূর্তিগড়ার জন্য শিল্পী ও কারিগর আনা হয়েছে ত্রিপুরার উদয়পুর থেকে। কিন্তু সেদিকে মন নেই অভির। সে ক্ষণে ক্ষণেই চোখ রাখছে সুধামাসির ঘরের দিকে, জানালা দিয়ে সুধামাসির ঘর পুরোটাই দেখা যায়। এখনো আসেননি মাসিমা। কেয়া, পপি ওরা সবাই তৈরি হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই এসে গেছে সমি ছদ্মবেশে। অভি এবং কেয়া দেখে ফেলেছে এক ঝলক। আসলে সমিই দেখা দিয়েছে মুখঢাকা কালো চাদর সরিয়ে। মুখে ঘন দাঁড়ি, চুল বেশ লম্বা, বড় বড় দুটি চোখ, পাতলা লালচে ঠোঁট। পরনে বাদামি রঙের খদ্দরের পাজামা ও পাঞ্জাবি। দ্রুত চলে গেল বাড়ির পেছনে লোকচক্ষু এড়িয়ে। কেয়া বিষণ্ন হাসি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানালো।

ঠিক সন্ধে সাতটার দিকে ভীড় ঠেলে ঠেলে উপলার মা উপলাকে হাত ধরে মহিলাদের লাইনে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক সেই সময় অভি কিছু প্রসাদের প্যাকেট বুকে চেপে পুজোর অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল, মুখোমুখি হয়ে গেল তাদের। মাথা নত করে উপলার মাকে হেসে প্রণাম জানালো, উপলাকে দেখে বিস্ময়ে চোখ নিষ্পলক হয়ে গেল তার কয়েক মুহূর্তের জন্য! মনে হল মণ্ডপ থেকে যেন দুর্গাদেবী নেমে এসেছেন! হলুদ লাল পেড়ে সুতির শাড়িতে ফর্সা উপলাকে কী যে সুদর লাগছে! মুখে এখনো হলুদের আভা ছড়িয়ে আছে। কুঁকড়ানো ঘন কালো চুল পিঠ বেয়ে নেমেছে। কানে ঝুমকো দুল। ঠোঁটে টকটকে লাল রং। দৃষ্টি ফেরাতে পারছিল না অভি! অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘কেমন আছিস উপলা? অনেকদিন পর দেখতে পেলাম তোকে। খুব ভালো লাগছে।’ বলেই চলে গেল অভি। উপলা মাথা নিচু করে ছিল। কিছুই বলল না। মাসিমা অভিকে না দেখার ভান করলেন।

দেবীকে উপলা এবং মাসিমা প্রণাম জানিয়ে আবার ভিড় ঠেলেঠুলে লাইন থেকে বেরিয়ে এসে সুধামাসির ঘরে গিয়ে পৌঁছলেন। অভি জানালা দিয়ে দেখতে পেল, সুধামাসি দুজনের হাত ধরে বিছানার ওপর বসালেন। অভি দ্রুত গিয়ে কেয়াকে কানে কানে কী যেন বলল।

কিছুক্ষণ পর কেয়া সুধামাসির ঘরে গিয়ে উপলার মাকে প্রণাম করল। মাসিমা উপলার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। তখন কেয়া উপলাকে বলল, ‘কেমন আছিস উপলা? চল্না একটু ঘুরে আসবি! শিখা, রেখা, পপি, ছবি, পারমিতা এসেছে। বিয়ের পর তো চলেই যাবি! আবার কবে দেখা হয়! মাসিমা উপলাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি?’

উপলার মা কিছু বলার আগেই সুধামাসি বললেন, ‘আরে যা যা! আজ বিজয়া দশমী ঘুরেটুরে দ্যাখ্! পুজো শেষ হলেই তো আবার এক বছরের জন্য নীরব হয়ে যাবে পাড়াটা কী বলেন দিদি?’

উপলার মা বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সুধাদি, ঠিকই বলেছেন। যা উপলা ঘুরে আয়। বেশি দূর যাসনে যেন! আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসিস।’
উপলা ভয়ভয় চেহারা নিয়ে বলল,‘যাচ্ছি মা।’ উপলার মা মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

পাশের ঘরে আসতেই কেয়া উপলার কানে কানে অস্ফুট স্বরে বলল,‘সমি এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য। চল্ আমার সঙ্গে।’
বিস্ফারিত চোখে উপলা ফিস ফিস করে বলল,‘কোথায়!’

—‘আয় আমার সঙ্গে।’ বলে উপলাকে টেনে টেনে বাড়ির পেছনে শিউলির ঝোঁপের কাছে নিয়ে আস্তে করে ডাকল, ‘সমি, তুই কোথায়? উপলাকে নিয়ে এসেছি। কথা বল্।’ বলেই সরে গেল কেয়া। ওদিকে পপিরা ঘোরাঘুরি করে উপলার মার দিকে নজর রাখতে লেগে গেল। দূর থেকে সব দেখছিল অভি।

শিউলি ফুল এখনো ফোটা শুরু করেনি, তবে সকালের কিছু বিবর্ণ ফুল রয়ে গেছে গাছে। ঝিরঝিরে হিমেল বাতাসে হালকা একটা গন্ধ। ধুপধুনোর গন্ধও আসছে মণ্ডপ থেকে। আকাশে অর্ধাকৃতি চাঁদ। ম্লান জোছনার আলোয় দেখতে পেল দুজন দুজনকে। রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে উপলা। বুকটা ভীষণ ধুকপুক করছে তার। সমি অবাক চোখে উপলাকে কিছুক্ষণ দেখল! একি উপলা নাকি মণ্ডপের ওই দুর্গাদেবী! এত সুন্দর কি ছিল কখনো উপলা! আবেগ থরো থরো বুকে জড়িয়ে ধরল উপলাকে সাজোরে সমি। কানের কাছে মুখ এনে বলল,‘উপলা, আমাকে ক্ষমা করিস! আর হয় তো কোনোদিন দেখা হবে না। ভুলে যাস আমাকে। আমি ভীরু, কাপুরুষ, অধম তাই তোকে উদ্ধার করতে পারলাম না! আমাকে ভুলে যাস! ভুলে যাস!’
উপলা সহসা ডুকরে কেঁদে উঠল,‘আমার জন্য তোমাকে অপমানিত হতে হল। তোমার শেষ চিঠিটি কাজের মেয়েটা কীভাবে যে দক্ষিণের জানালার ফাঁকে দেখতে পেয়ে মার হাতে তুলে দিল আমি জানতেও পারিনি! তারপর তো সর্বনাশ হয়ে গেল! বাবা তোমাকে ডাকিয়ে এনে যেভাবে জাতপাত নিয়ে অপমান করেছে সেদিন আমি বিষ খেয়ে মরে যেতে চেয়েছিলাম! তারপরও আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরতে চেয়েছি দুদিন পর কিন্তু ডাক্তার এনে হাসপাতালে নিয়ে গেল মরতে দিল না! আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।’ উপলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে দেখে সমি বলল,‘আমাদের অদৃষ্ট উপলা! আমার ডাক্তারি পাশ করে বেরিয়ে আসতে আরও দুবছর বাকি। তোকে নিয়ে কোথাও ওঠারও সম্বল আমার নেই। ভালোবেসে কেবল তোর ক্ষতিই করে গেলাম! আমাকে ভুলে যাস উপলা! মনে করিস স্বপ্নে দেখেছিলি আমাকে, স্বপ্নেই আমি হারিয়ে গেছি!’
উপলা কিছুতেই কান্না থামতে পারছিল না। সে বসেই পড়ল সমির পায়ের কাছে। অস্ফুট স্বরে বলল,‘আমার দিকে তাকিয়ে আমার অবুঝ বাবা-মাকে তুমি ক্ষমা করে দিও সমি! একদিন বুঝতে পারবে কী ভুল করেছে ওরা! সেদিন ওদের জাত্যাভিমান ওদেরকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারবে!’ বলেই উপলা দ্রুত সেখান থেকে চলে এসে অদূরে কেয়ার কাছে এসে দাঁড়ালো। চোখমুখ মুছে একটি সোফায় মাথা নিচু করে বসে থাকল। কেয়া এসে ওর কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মাইকে তখন বাজছে লতার একটি গান—-‘না মনো লাগে না, এ জীবনে কিছু যেন ভালো লাগে না……….’
রাত বারোটার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন দিতে হবে। বড়দিঘির পূব পাড়ে ট্রাক এসে থামল। ঢুলিরা বাজনা-বাদ্য থামিয়ে দিল। পাড়ার হিন্দু ছাড়াও মুসলমান অনেকেই এসেছে বিসর্জন দেখার জন্য। অভির মন একেবারেই নিস্তেজ হয়ে গেছে। শুধু অভিই নয়—বন্ধুবান্ধবী সবারই মন খারাপ হয়ে গেল একাধিক কারণে, দুর্গাদেবীর বিসর্জন, যেকদিন পুজো ছিল দেবীর প্রতি একটা মায়া জন্মেছিল। আশৈশব খেলার সাথী উপলার বিয়ে হয়ে চলে যাচ্ছে সে সুদূর বিদেশে, আর কবে দেখা হবে কে জানে! উপলার বিয়ের পর সমিও আর কোনো সম্পর্ক রাখবে কিনা অভিদের সঙ্গে সন্দেহ আছে। জলভারী একটা একাকিত্ব উথলে উঠছে বুকের ভেতরে সবার যা ব্যাখ্যা করার উপায় নেই।
সমি অধিকাংশ সময়ই মুখ ঢেকেই রইল। মৃতসঞ্জিবনী পান করল অভিদের সঙ্গে প্রচুর। নেশার ঘোরলাগা চোখে অভিকে কানে কানে বলল,‘কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো অভি তোদেরকে আমি জানি না। উপলাকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখার দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছিস! তোদের মঙ্গল হোক।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুট স্বরে বলল,‘এক জনমে হাজার জনমের স্বপ্ন যেন সফল হল! নারী তো নয়, সাক্ষাৎ দুর্গাদেবীকে যেন ক্ষণিকের জন্য জীবন্ত পেয়েছিলাম অভি! আমি তাতেই তৃপ্ত।’

অভি সমির কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তোদের দুজনকে একদিন একসঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে দেখব এই স্বপ্ন আমরাও দেখেছিলাম সমি। কত আনন্দ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু….কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল!…..কী হবে এইসব ধর্ম, পুজো, আচার, উৎসব করে বল্ যেখানে মানুষের কোনো মূল্য নেই! টাকা, রাজনীতি, ক্ষমতা, লুটপাট, জাতপাতই কি একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির পরিচয়?’

বহুজন মিলে ভারী মণ্ডপ ধরাধরি করে জলে নামানো হল। জলের ওপর শুইয়ে দেয়া হল। জলের ঢেউ লেগে দ্রুত খুলে খুলে যেতে লাগল মাটি, রং, খড় আর কাপড়। পাড়ে রাখা হ্যাজাকের আলোয় চিক চিক করছে জল। কাঁসর আর করতাল বাজিয়ে চলেছে ছেলেরা। ঠাকুর মন্ত্র পাঠ করছেন একটানা। মেয়েরা উলুধ্বনি দিচ্ছে। ভেসে চলে যাচ্ছে বাঁশের লাঠিগুলো। একসময় সবাই এক এক করে শেষ ডুব দিয়ে জল থেকে পাড়ে উঠে এলো। শেষবার ভাসমান ভেঙে ছারখার হয়ে যাওয়া মণ্ডপের অংশগুলো দেখে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল ভগ্ন-বিষণ্ণ মনে। অভি আগে আগে আর পেছনে সবাই।
পরের দিন ভোরবেলা ভাঙা মণ্ডপের একাংশের সঙ্গে সমির লাশও ভেসে এসে দিঘির ঘাটে লেগে আছে দেখতে পেল পাড়ার এক কিশোর। দৌড়ে এসে খবর দিল অভিকে।