বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রয়াণ

 

inside post

।। অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ।।

প্রয়াত অধ্যক্ষ আফজল খানের সহধর্মিনী মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী নার্গিস সুলতানা ১২ জুন ২০২৪ইং রাত ১০টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসারত অবস্থায় ঢাকায় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি জন্মসূত্রে সিলেট জেলার একজন স্বনামধন্য ডিএসপি সাহেবের কন্যা ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বৎসর। তাঁহার ঔরসে জন্মেছিল তিনজন ছেলে একজন মেয়ে। বড় সন্তান বা বড় মেয়ে হচ্ছেন আঞ্জুম সুলতানা সীমা, কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য। বড় ছেলে জননেতা মাসুদ পারভেজ খান ইমরান ২০২৩ সালের ৬ মার্চ হৃদযন্ত্রের বৈকল্যে মৃত্যুবরণ করেন। মেঝ ছেলে ডা: আজম খান নোমান কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সম্মানিত পরিচালক। ছোট ছেলে নাসরুলরাহ খান আরমান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁর স্বামী অধ্যক্ষ আফজল খান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কুমিল্লার গণমানুষের নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষানুরাগী ও এতদঅঞ্চলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা। যিনি ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হন ।

আফজল খান সাহেব মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনকালে সোনামুড়া ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন। সোনামুড়া ক্যাম্পে শরণার্থীদের থাকা খাওয়া থেকে মুক্তিযুদ্ধাদের ট্রেনিং পাওয়ার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন নার্গিস আফজাল ও শীলা আনসার। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশে প্রেরণের সময় অস্ত্র সরবরাহে তিনি সহায়তা করতেন এবং সার্বিক সাহস যোগাতে এবং একটি বৈষম্যহীন, ক্ষুধামুক্ত, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত সোনার বাংলা গড়ায় ঝাপিয়ে পড়তে যুদ্ধংদেহী মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করেছেন। ক্যাম্পের কাছেই এক কৃষকের নিকট চেয়ে নিলেন তাঁর গরুর ঘরটি। যাতে একটি চৌকী ফেলে সাথী শিলা আপাকে নিয়ে বসবাস করতেন। নিজের জন্য খাওয়া আছে কিনা তার খবর নাই কিন্তু শরনার্থী শিবিরের সবার জন্য পাক হয়েছে কিনা, রিলিফের কাপড়গুলি কাদের মধ্যে বন্টন করা যায়, বাজার যে করেছে সে অর্থের সৎব্যবহার করেছে কিনা এ নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পর আফজল খানের রাজনীতি ও সংগঠন করার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন। সমাজ সেবার একটা বিরাট অংশের বাস্তবতায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর কুমিল্লা আসলে তার বহরকে কয়েকদিন কুমিল্লায় ঘুরিয়েছেন জননেতা আফজল খান। কিন্তু নেত্রীর সকল আবদার সামলিয়েছেন আমাদের সকলের বরণীয় আফজল খান সহধর্মিনী নার্গিস আফজল। শিক্ষানুরাগী আফজল খানের স্কুল কলেজ চালানোর সুবিধার্থে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বিএড ভর্তি হয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শুরু করেন মডার্ণ স্কুলের শিক্ষকতা এবং কিছুদিন পর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে স্কুলটিকে কুমিল্লা অঞ্চলের একটি কৃতি স্কুলে রুপান্তরিত করেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিকট নার্গিস আফজল হয়ে উঠেন একজন আদর্শ শিক্ষক, শিক্ষাগারের আদর্শ প্রশাসক। সাংগঠনিক কিছু গণ্ডগোলের কারণে মডার্ণ স্কুল থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়। কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হন নাই, গড়ে তুলেছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মডার্ণ হাই স্কুল। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই স্কুলে যুক্ত থেকে এই স্কুলটিকে গড়ে গেছেন নগরীর আরেকটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ।

সংসার, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজকর্ম, বিদ্যার্চ্চা ও আপনজনের সেবায় সদা নিয়োজিত নার্গিস আফজল হয়ে উঠেন রোগাক্রান্ত। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে শেষে চিকিৎসা নিতেন সিডি প্যাথের ডা: জহিরের চেম্বারে। ডা: জহির শেষ পর্যন্ত সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তারপরও ঢাকা যাওয়ার একটি শেষ অভিলাস। মেয়ে সীমা ও ছেলে ডা: নোমান নিয়ে গেল ঢাকার একটি হাসপাতালে । কিন্তু মৃত্যু তাঁকে ছাড় দিতে নারাজ। ১২ জুন রাত ১০টা ৪০ মিনিটে আজরাইল (আ:) এসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিয়ে গেল পরপারে। বৃহস্পতিবার ১৩ জুন বাদ যোহর নগরীর মডার্ণ কমিউনিটি সেন্টারের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জানাযা। প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, উকিল, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, ছাত্র চাকরিজীবীসহ সকল মহলের লোক অংশ গ্রহণ করে এ জানাযায়। এক মহান মহিলা মুক্তিযোদ্ধার শেষ বিদায়। কুমিল্লাবাসীর পক্ষ থেকে তোমায় জানাই সেলিউট। মহান আল্লাহ তোমাকে বেহেশতের উত্তম স্থানে অধিষ্ঠিত করুক- এটাই আমাদের কামনা ।

লেখক:প্রাক্তন অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।

 

আরো পড়ুন