ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
তখন ভোররাত। মাত্র কয়েক মিনিটের সময়। আচমকা বাজখাঁই গতির ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিনটি উপজেলা এলাকার কয়েকটি গ্রাম করে দিয়েছে লণ্ডভণ্ড। আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। অন্তত চারশ’ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়াসহ ওঠতি বোরো ধান ও ফসলি জমির হয়েছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।বহু পরিবারে ওঠেছে হাহাকার। তবে সবচে’ বেশি ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে জেলার নাসিরনগর উপজেলায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে অনেক এলাকায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এলাকাবাসী এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোমবার ভোর তিনটা ১১ মিনিটে জেলার নাসিরনগর উপজেলা এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এসময় ঘরের চালাসহ গাছপালা ভেঙে পড়ার আঘাতে আহত হয়েছে শিশুসহ অন্তত ৪০ জন নারী-পুরুষ। এর মধ্যে একজনকে গুরুতর অবস্থায় প্রেরণ করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে। ঘুর্ণিঝড়ের সময় দমকা বাতাসের সাথে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিতে ওঠতি ফসলরেও হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। বিভিন্ন গ্রামের বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়ে গেছে বন্ধ। উপজেলার ভলাকুট এবং চাতলপাড় ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে যায় ক্ষিপ্র গতির ঘূর্ণিঝড়। এই দুটি ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম বিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া পূর্বভাগ ইউনিয়ন এলাকায়ও ঘূর্ণিঝড়ের কিছুটা প্রভাব পড়েছে। সবচে’ বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উপজেলার ভলাকুট ইউনিয়নের ভলাকুট, বালিখোলা, কান্দি, দূর্গাপুর, খাগালিয়া, বাগি, কাহেতুড়া গ্রামগুলোতে। পূর্ব বালিখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ধ্বসে পরায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বিদ্যালয়। বহু পরিবারের মানুষজন অবস্থান করছেন খোলা আকাশের নিচে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মানুষেরা জানান, সেহরির সময় শুরুর দিকে হঠাৎই আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই প্রবল বেগে শুরু হয় ঝড়। কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যেই সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
নাসিরনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাইদ তারেক জানান, ‘শিলাবৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নভাবে ১৫০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তাছাড়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হচ্ছে।’ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিত রায় জানান, ‘ঘূর্ণিঝড়ে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছে। তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বিধ্বস্ত এলাকায় একটি মেডিক্যাল টিম নিয়োজিত রয়েছে।’
সরাইল উপজেলা :
এদিকে জেলার সরাইল উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে পাকা ধান ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মানুষজন জানান, রাত তিনটার দিকে হঠাৎ আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই প্রবল বেগে ঝড়-বাতাস বইতে শুরু করে। দমকা হাওয়ার সাথে শুরু হয় প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি। উপজেলার অরুয়াইল-পাকশিমুল সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। অরুয়াইল গ্রামের নুর মাহমুদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী আখড়ার বিশালাকার গাছ পড়ে তিনটি ঘর ভেঙ্গে গেছে। রাণীদিয়া মাদরাসার টিনশেড ঘরের চালা উড়ে গিয়ে পাশের বাড়িতে আঘাত করে। দুবাজাইল গ্রামের আনিসুর রহমানের বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির চালাটি উড়িয়ে নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় ১৫ জন আহত হয়েছে। উপড়ে গেছে গাছপালা, ভেঙ্গে গেছে ঘরবাড়ি, ধান ও ভুট্টা গাছগুলো হেলে পড়েছে।গাছ থেকে ঝরে পড়েছে মরিচ। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঝড়ের আঘাতে অধিকাংশ ঝুপড়ি ঘর, টিনশেড ঘর, গাছপালা ভেঙে হয়ে গেছে লণ্ডভণ্ড। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। এসব এলাকায় রাত তিনটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
সরাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আকরাম হোসেন বলেন, ‘ঝড়ে নুয়ে পড়া পাকা ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। তবে শিলা বৃষ্টিতে সামান্য ক্ষতি হয়েছে। আমরা ঝড়ে ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষয় ক্ষতির তালিকা তৈরি করছি।’
বিজয়নগর উপজেলা :
জেলার বিজয়নগর উপজেলার চরইসলামপুর ইউনিয়নের নাজিরাবাড়ি, বুধন্তী ইউনিয়নের বুধন্তী, হরষপুর ইউনিয়নের বুল্লা, চান্দুরা ইউনিয়নের রামপুর, রসুলপুর, ভাটি কালিসীমা, বেকিনগর, চম্পকনগর ইউনিয়নের পেটুয়াজুড়ি, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুরসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত শতাধিক ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়। এছাড়াও বিজয়নগর উপজেলায় ১০০ হেক্টর জমির বোরো ধান এবং ৫০ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসল এবং বাগানের ক্ষতি হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিস।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমীন ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শেষে জানান, ‘ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করে ক্ষতিগ্রস্থদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে।’