মশলার কাব্যে জাতীয় চরিত্র বিশ্লেষণ


মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের একজন গড়পড়তা বাঙালি প্রতিদিন প্রায় ২০,০০০ শব্দ বলে! হিসাব করে দেখা গেছে—১৮ কোটি বাঙালির মুখ দিয়ে প্রতিদিন বেরিয়ে আসে প্রায় ৩৬০০ বিলিয়ন শব্দ! এ যেন জিবের গহ্বরে গর্জে ওঠা এক কথার ভূকম্পন! নাসা ইতোমধ্যেই সন্দেহ করেছে—এই ভোকাল ভলকানোই বুঝি পৃথিবীর কম্পনের উৎস!
আমরা এমন এক জাতি, যাদের মুখ বন্ধ করা যায় না—শুধু মুখেই নয়, ফুসফুস, পাকস্থলী, এমনকি হজমতন্ত্র পর্যন্ত মশলার প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত! কেউ না কেউ ঠিকই বলে ফেলবে, “আমি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে!”
আর এ বলতেই হবে জাতীয়তাই আমাদের মূল উপাদান: মশলা। হ্যাঁ, আমরা আসলে মশলাজাতীয় জাতি! যেমন :
পেঁয়াজ: জাতীয় আবেগের অশ্রুজল
পেঁয়াজের দাম বাড়লেই রাজনীতি উত্তপ্ত, ফেসবুক ঝাঁজালো, বাজারে কান্নার স্রোত! কেউ প্রেমে ছ্যাঁকা খেলেও বলে, ‘ভাই, পেঁয়াজের মতো চোখ জ্বলছে।’ অর্থাৎ, আমাদের কান্নাও ব্র্যান্ডেড মশলা-আশ্রিত।
মরিচ: ঝাঁজালো মতামতের মাস্তান
তুমি যদি বলো, ‘আমি নিরপেক্ষ’, সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাল কমেন্ট:—’তুই তাহলে ওই দলের?’— :দেশদ্রোহী!’
আসলে, মত প্রকাশ নয়—মত দহন আমাদের রীতি!
রসুন: পেছনের প্লটের প্রোডিউসার
মুখে মিষ্টি, পেছনে ফিসফিস—’ওরে চেনো না তুমি!’ এ ‘রসুনি’ জাতি মুখে বলে না, কিন্তু চারপাশে গন্ধ ছড়ায়—মননশীল সম্পর্ক গুলোর ক্ষয় শুরু হয় এখানেই।
আদা: কণ্ঠস্বরের কড়ামরিচ
কেউ একটু কড়া সুরে কিছু বললে—’আরে, আদা ফুটতেছে ভাই!’ এই উষ্ণতা আমাদের ঘরে-বাইরে উত্তাপ ছড়ায়, মাঝে মাঝে তো কথার ফোঁড়নেই রাঁধুনি পুড়ে যায়!
হলুদ: বাহ্যিক সৌন্দর্য আর পেছনের গল্প
‘স্যার, আপনি জাতির গর্ব!’ কিন্তু পেছনে? ‘ওরে ভাই, ভেতরের কাহিনী জানো না!’
হলুদ শুধু রং নয়, চরিত্রেরও এক বৈশিষ্ট্য।
তেজপাতা: নীরব কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ঢুকতি
বসন্ত বাতাসের মতো আসে—কথায় বিশেষ কিছু থাকে না, কিন্তু উপস্থিতি জানান দেয়, ‘আমি আছি… কিছু বলছি না… তবে একটা কথা আছে।’
লবণ: আলোচনা জমায়, আবার সবকিছু নষ্টও করে
কিছু মানুষ থাকেন, যাদের উপস্থিতি না থাকলে আড্ডা শুকনো লাগে। আবার বেশিই বললে বলি: ‘এই লোকটাই সব নষ্টের মূল!’ অতিলবণেই যেমন তরকারি নষ্ট, অতি বক্তব্যেও বন্ধুত্ব ফিকে।
মেথি: ফোঁড়নের ফিসফাস
একটু বললেই ঘ্রাণ, বেশি বললেই তিতা। সমাজের কিছু মতামতদাতা ঠিক এরকম—ঠিক সময়ে বললে দারুণ, ভুল জায়গায় বললে তিক্ততা ছড়ায়।
দারুচিনি: অভিজাত ভাবের বক্তা
‘আমার বিনীত মতামত হচ্ছে…’— এরকম শুরু করেই বোঝা যায়, বক্তা এ মুহূর্তে জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছেন নিজেকে ভেবে।
জয়ত্রি-জয়ফল: পরিচিতির বাইরেও অতিজ্ঞানী
জ্ঞানী, ধীর, চিন্তাশীল—কিন্তু সমাজে উপেক্ষিত। এগুলো যেন পেঁয়াজের নিচে লুকানো বীজের মতো, কেউ বুঝে না কিন্তু গন্ধটা লেগে থাকে।
সবশেষে বলা যায়, এ পুরো মশলা বাহিনী মিলে আমরা এক হাঁড়ির ঝোল। সেখানে জাতীয় সংসদ থেকে চায়ের দোকন—সব খানেই শব্দের তেল, মন্তব্যের ফোঁড়ন, কটূক্তির মরিচ আর চাটুকারিতার হলুদ!
আমরা ঝাঁঝে থাকি, রঙে মাখা এক জাতি—