মাছের ভালোবাসায় যে জীবন পার!

 

।। মতিন সৈকত।।

‘আমি আমার মায়ের কথা বলছি/

তিনি বলতেন প্রবহমান নদী/

যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।/

যে কবিতা শুনতে জানে না/

সে নদীতে ভাসতে পারে না।/

যে কবিতা শুনতে জানে না/

সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।’/

কবি আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ’র এ কবিতাটির মতই সুন্দর তৎকালীন থানা শিক্ষা  কর্মকর্তা মো. আব্দুল গফুর বিএ এবং  লায়লা খাতুন দম্পতির সংসার। তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে প্রফেসর ডা. মোঃ আতাউর রহমান,  এমবিবিএস,এমএস(সার্জারি)। অধ্যক্ষ (অব.) কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ। বর্তমানে ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লায় সার্জারির প্রফেসর।

পিতা মাতার তৃতীয় সন্তান ড. মোঃ খলিলুর রহমান। জন্ম গ্রহণ করেন ২২ অক্টোবর ১৯৬৩। কিশোরগঞ্জ জেলার তারাইল থানার চরতালজাঙ্গা গ্রামে। বাবা ঢাকায় শিক্ষা অফিসার পদে কর্মরত থাকায় খলিলুর রহমান রাজধানী শহরে পড়াশোনার সুযোগ পান। ঢাকার মাঠে খেলাধুলা, হৈ-হল্লা আর মানুষের বিচিত্র জীবন-জীবিকা  দেখে বেড়ে উঠেন তিনি। শিক্ষা,সংস্কৃতির পাশাপাশি সমৃদ্ধ শৈশব-কৈশোর- তারুণ্যে উদ্দীপিত হন। কিংবদন্তিদের সরাসরি  ছুঁয়ে দেখার ঈর্ষণীয় সাফল্য স্পর্শ করেন। গ্রামে জন্ম এবং শহরে বড় হওয়ার কারণে তিনি সমাজ-সভ্যতাকে লালন করে ঋদ্ধ হয়ে উঠেন।

তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় রাজধানীর কোব্বাদ সরদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সে সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন সবাই নিরাপত্তার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে পালাচ্ছেন। সে সময়ে কিশোর খলিল বাবা-মায়ের সাথে দেশের বাড়িতে রওয়ানা দেন। ৩১ মার্চ ১৯৭১ বেবী টেক্সিতে বাসা থেকে তেজগাঁওয়ে আসেন। সেখান থেকে হেঁটে ৫ দিনে কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়ি পৌঁছেন। কিশোর খলিল স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ  দেখেন এবং  মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে বেড়ে উঠেন। বয়সে ছোট থাকার জন্য তিনি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি। পরবর্তীতে লেখাপড়া শেষ করে তিনি দেশ গড়ার যোদ্ধা হয়ে উঠেন। মাধ্যমিক পাশ করেন ঢাকার ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ হতে।

তিনি ১৯৮০-৮১ শিক্ষা বর্ষে ভর্তি হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদে। কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চল প্রাকৃতিক মাছের জন্য বিখ্যাত। তখন গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছের প্রাচুর্য্য ছিল। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান খলিল জেনেটিকভাবেই মাছের মানুষ। আবার মাছ নিয়ে পড়তে বসেন। মাছের পরম ভালোবাসায় ডুবে যান। তার ধ্যানে জ্ঞানে চিন্তা চেতনায় স্বপনে জাগরণে মাছ।

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ চিরায়ত এ অবস্থানটি কিভাবে ধরে রাখা যায়। প্রাকৃতিক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কি করে চাষের মাছকে সমৃদ্ধ করা যায়। উৎপাদন বাড়ানো যায়।

শিক্ষকদের বক্তব্য শুনার পাশাপাশি গবেষণায় নিজেকে নিবেদিত রাখেন। অন্যদের থেকে একটু আলাদা করে মাছ নিয়ে, দেশ নিয়ে ভাবেন খলিল।  ক্লাসে, গবেষণাগারে, পুকুর-দিঘিতে চলে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ। জলাশয়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক মাছের অভয়াশ্রম নিয়ে ও চিন্তা করেন। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। খলিল স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। দেশ গড়ার স্বপ্ন। মৎস্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি দেশ সেরা মাছের কারিগর হয়ে উঠেন।

ড. খলিল মাছের সঙ্গে খেলা করেন। প্রবাহমান নদী তাকে ভাসিয়ে রাখে। তিনি কবিতা শুনতে জানেন। সে কবিতা মাছ হয়ে তাকে মাছের কবি বানিয়ে রাখেন। হয়ে উঠেন মাছের বাউল। মাছ ভালোবেসে কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন।

১৯৮৬ সনে তিনি বিএসসি ফিশারিজ অনার্স পাশ করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ ইন্টারভিউ দেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বন্ধুর কাছে শুনলেন তার চাকরি হয়েছে। সদর দপ্তর, এফআরআই থেকে নিয়োগ পত্র সংগ্রহ করলেন।  মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে  যোগদান করেন  মোঃ খলিলুর রহমান। প্রথম পোস্টিং নদী মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র,  চাঁদপুর।  এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। নেশা পেশা ভালোবাসা এক হলে যা হয়। আর কে পায়?

চাকরি কি ভাবে হলো টের পাননি খলিল। তার বাবা এবং বড় ভাই জিজ্ঞেস করলেন,  কবে আবেদন করলি? কবে ইন্টারভিউ দিলি?

অনার্স  রেজাল্টে প্রথম ৭ জনের মধ্যে থাকায় এবং ইন্টারভিউ ভাল করার কারণে তার নিয়োগ প্রাপ্তি। চাকরি থেকে যোগদানের লক্ষ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  ঢাকার বাসায় আসেন খলিল। বাবা, মা, ভাই, বোন ও ভাবীর সাথে দেখা করে পর দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি সদরঘাট থেকে কর্মস্থল  চাঁদপুরের ষোলঘর নদী মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে  পৌঁছেন।

মনে তাঁর আনন্দ ধরেনা। নতুন চাকরি, নতুন ঠিকানা। নতুন উদ্যোম। অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি। চাঁদপুরের শীতল পাগলা হাওয়ায় দুলতে থাকেন খলিল। কবি নজরুলের ভাষায়

” আজ সৃষ্টি- সুখের উল্লাসে / মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/ আজ সৃষ্টি -সুখের উল্লাসে। ”

পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি।

১৯৯৩ সনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে থাই পাঙ্গাশ মাছের পোনা উৎপাদন করে তিনি  রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন। এর পর পরই FAO Scholarship নিয়ে England এর Hull University তে MS করতে যান। ১৯৯৪ সনে অক্টোবর G SSO হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। আবার ১৯৯৮ সনে World Bank,  ARMP Scholarship নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিইচডি করতে যান।

BFRI’ সব বৈজ্ঞানিক পদেই চাকরি করেছেন তিনি। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ), পরিচালক (গবেষণা ও পরিকল্পনা)।

২৮  ফেব্রুয়ারি ২০২২ চাকরিতে ৩৬ বছর পূর্ণ করেন ড. মোঃ খলিলুর রহমান। তিনি কিছুদিন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক এর দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। দেশের সেবায় ড.খলিল নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করে গেছেন।

মাছ, জলজ পরিবেশ, ব্লু-ইকোনমি, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিষয়ে কাজ করতে তাঁর ভাল লাগে।

গবেষণায় সাফল্য, সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা,  উদ্দমতার স্বীকৃতি স্বরূপ মহাপরিচালক কর্তৃক ২টি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট লাভ করেন।

৩০ জুন ২০০৪ সালে প্রথমবারের মত দেশী পাঙ্গাশ মাছের কৃত্রিম প্রজননের সফলতা অর্জন করেন। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি হয়ে যান পাঙ্গাশ খলিল। দেশে উৎপাদিত যে পাঙ্গাশ মাছ খাই। সেটি তিনি বাংলাদেশে প্রথম রেণু সফলভাবে উৎপাদন করেন।

ড. খলিল চাকরিকে ইবাদত মনে করেছেন। তিনি দেশের প্রয়োজনে গবেষণা, লেখালেখিতে জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর আরেকটি  মহৎ উদ্দেশ্য ছিল দেশে মাছ উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা।

আল্লাহর অশেষ রহমতে  বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশ মিঠা পানিতে মাছ উৎপাদনে কখনো  দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। আমাদের ইলিশ সবসময়ই বিশ্বের সর্বশীর্ষে।

বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করবে ইনশাআল্লাহ।  আবহাওয়া অনুকূল এবং ড. খলিলদের মত গবেষক, বিজ্ঞানী ও দেশের মৎস্য খামারীদের সর্বশক্তি নিয়োগের ফলে মাছ উৎপাদনে উত্তরোত্তর সাফল্য আসছে।

মাছ নিয়ে বাংলাদেশকে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। মৎস্য যোদ্ধা ড.খলিলুর রহমান জাতীয় প্রেরণা হয়ে থাকবেন। দেশের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষক বিজ্ঞানীদের আরও বেশি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পাঙ্গাশ খলিলের মত মাছের নামের আগে  বিজ্ঞানীদের নাম যেন যুক্ত হয় সে রকম সফলতা অর্জন করতে হবে।

ড. খলিলের  ৭৮টি  বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দেশ বিদেশের  বিভিন্ন জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর কয়েকটি প্রকাশনা।

  1. Ecology and Management of Inland Waters and Fishery Resources of Bangladesh.2015 Page: 952

 

২. বাংলাদেশের বাহারী মাছ। ওহ: অপ্রচলিত মৎস্য সম্পদ: অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল।

পাতা: ৪৮-৫৩

 

3৷ Riverine Catfish (Pangas) In: Hand Book of Agricultural Technology.

Page: 196-199.

4৷ Fish and Fisheries of Kaptai Reservoir,  Bangladesh.  In: Management Ecology of Lake and Reservoir Fisheries.

Page: 144-158.

5৷ Stock Assessment in Tropics – Methods and Problems. In: Fish Population Dynamics and Inland Fishing Technology.

Page: 56-64.

 

তাঁর সহধর্মিণী সহযোদ্ধা  ড. জুবাইদা নাসরীন আখতার ও একজন খ্যতিমান মৎস্য বিজ্ঞানী।

তিনি অবসররাপ্ত পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন)।  ইংল্যান্ড এর হাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চযউ করেছেন। তাঁরা সুখী দম্পতি। তাদের সংসারটি সোনায় সোহাগা। তাদের সন্তানরা ও পিতা মাতার যোগ্য উত্তরসূরী এবং সফল স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদাহরণ। তাঁদের দুই ছেলে ইংল্যান্ডে। বড় ছেলে: ডা. নাদিম রহমান।

তার স্ত্রী ডা. শারমিন সুলতানা তুলি। NHS, England এর ডাক্তার। ছোট ছেলে: নাভিদ রহমান

ই ই ই ইঞ্জিনিয়ার হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে Renewable Energy বিষয়ে এমএস করছে। তার স্ত্রী রহিমা আক্তার

ফার্মাসিস্ট। হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে MPharm করছে। সৌভাগ্যের বিষয় ড, খলিল রহমান দম্পতি  এই হাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই PhD করেছিলেন। ইংল্যান্ডের হাল বিশ্ববিদ্যালয় যেন তাদেরকে স্বপরিবারে পেয়ে ধন্য।

বিজ্ঞানী কি চাকরি শেষ হয়ে গেলে অবসর জীবন যাপন করতে পারেন?

না। পারেন না। বরং তার দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। তিনি তখন হয়ে উঠেন জাতীয় অভিভাবক। পরামর্শক।  নির্দেশক। কনসালটেন্ট। তিনি তখন রাষ্ট্র, সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেন। ড. খলিলুর রহমান একজন সৃজনশীল উদ্ভাবক-উদ্যোক্তা। বিভিন্ন টেলিভিশন এবং প্রচার মাধ্যমে তিনি দীর্ঘ দিন মৎস্য বিষয়ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরামর্শ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন মৎস্য উৎপাদনে আগের মতই সক্রিয় থাকার জন্য অঙ্গিকারবদ্ধ।

 

লেখক: জাতীয় পরিবেশ পদক এবং দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত।

    matinsaikot507@gmail.com