মুক্ত সাংবাদিকতা ও প্রতিবন্ধকতা

।। ইয়াসমীন রীমা।।
যোগাযোগের নেটওয়ার্কে বিশ্ব এখন এক সূতায় বাঁধা। তাই গোটা বিশ্বকে যোগাযোগের ভাষায় বলা হচ্ছে “গ্লোবাল ভিলেজ”। আর বাংলাদেশ নামক ভিলেজটি দুনীর্তি সত্ত্বে উন্নয়নের এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে যখন একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছা মাত্র দিনের ব্যাপার। এ যে বিশ^ দেশটি যোগাযোগের একটি ছোট্ট গ্রামে পরিণত হয়েছে,তা শুধু সড়ক,জল বা আকাশপথে নয়। সাংবাদিকতার ভাষায় আমরা যে যোগাযোগকে গণযোগাযোগ বলি সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে ছোট্ট একটি গ্রামে। ঢাকা ও প্রধান শহরে তো বটেই জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও সংবাদপত্র বেরুচ্ছে নিয়মিত। ঢাকা থেকে প্রচারিত সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। এরপরও রয়েছে জাতীয় -আঞ্চলিক সংবাদপত্রের বিভাজন। কিন্তুু ভৌত অবকাঠোমের ক্ষেত্রে যাই হোক,গণযোগাযোগের বেলায় বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলকে যে আজ আর মফস্বল বলা যাবে না- একথা যতো জোরে সম্ভব ততো জোরে দিয়ে বলতে হয় আরেকটি বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে। দেশের নানা অঞ্চলে কর্মরত সাংবাদিকরা আমাদের মূলধারার সংবাদকর্মীদের থেকে এতটুকু বিছিন্ন নন। তারা মূলধারার সাংবাদিকতারই সক্রিয় অংশ। তারকা হতে হবে এমন ধারণা পোষণ না করে অনেক পথিকৃৎ সাংবাদিক আছেন জাতীয় কাগজগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাঠিয়ে থাকেন।
রাজধানী কেন্দ্রিক লাইমলাইটের বাইরে থাকেন বলে মফস্বল সাংবাদিক বা স্থানীয় সাংবাদিক। আর এ-সাংবাদিকদের যে চর্চা তাই স্থানীয় সাংবাদিকতা বা মফস্বল সাংবাদিকতা। অবশ্য মফস্বল সাংবাদিকতাকে হাল সময়ে গ্রাম সাংবাদিকতা,প্রান্তিক সাংবাদিকতা,আঞ্চলিক সাংবাদিকতা নামেও আখ্যায়িত হয়। সত্যিকার অর্থে জেলা বা উপজেলার কিছু সাহিত্য,সংস্কৃতিমনা তরুণ-তরুনী সমাজ বদলের স্বপ্ন,গণমানুষের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন,্এমননি হাজারো স্বপ্ন বুকে লালন করে এসে সাংবাদিক হতে চায়, কিন্তুু পাকা রাস্তার শেষ মাথায়ই থমকে দাঁড়ায় নগর। তাই জাতীয় পত্রিকাগুলোতে তাদের জায়গায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে সীমারেখা টেনে দেয়। ফলে ওই সীমাবদ্ধ জায়গায় শুধু প্রান্তিক মানুষের পড়ে পড়ে মার খাওয়া ছাড়া কিছুই আসেনা। স্থানীয় সাংবাদিকরা যখন তাদের নিজের পত্রিকা দ্বারা অবমূল্যায়িত হন তখন তাদের পেশার প্রতি অনীহা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এটি তাদের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা। এ-বিষয়ে পত্রিকার একজন স্থানীয় প্রতিনিধির অভিমত,আমরা স্থানীয় সাংবাদিকরা হয়তো কোনো ক্লু ধরে একটি প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠালাম। প্রতিবেদনটি ছাপার পর এলাকায় খুব আলাপ-আলোচনা সৃষ্টি হলো। কিন্তুু এরপর দেখা যায়,আমাদের বাদ দিয়ে এ-বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য ঢাকা থেকে হয়তো একজন স্টাফ রিপোর্টার বা সিনিয়ার রিপোর্টারকে পাঠিয়ে দিলো। তিনি এখানে এসে স্থানীয় বাস্তবতা না দেখে স্থানীয় জনমত না বুঝে,তার মতো একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন। এটিকে কেউ কেউ অবমূল্যায়ন বলেন না,বলেন প্রাথমিক প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দিয়েই এ-কাজ করা হয়। কিন্তুু এটা গুরুত্ব বিবেচনা করে গুরুত্বসহকারে প্রকাশের প্রাথমিক স্তর। কিন্তুু তাও সত্যি কথা নয়। কিংবা সত্যি হলেও তা না হওয়াই ভালো। কেননা তাতে আর যাই হোক সুশাসনের ব্যঘাত ঘটে। এমন উদাহরণও আছে পত্রিকার পাতায় নিজের পাঠানো সংবাদ ছাপানোর জন্য স্থানীয় সাংবাদিকরা অনেক সময় প্রেরিত প্রতিবেদনের সাথে মফস্বল সম্পাদককে একপ্রস্থ চিঠি অথবা নিজেকেই স্বয়ং মফস্বল সংবাদিকের সামনে যেতে হচ্ছে। মানুষ হিসেবে সাংবাদিকের কোনো শ্রেণীবিন্যাসের দরকার হয়তো নেই। তবুও একটি গ-ি তৈরি হয়ে গেছে। আধুনিক প্রযু্িক্তর কম্পিউটার ই-মেইল,ইন্টারনেট,অত্যাধুনিক অফসেট ছাপাখানার বাহারি রঙের কলেবরে দৈনিক পত্রিকার সৌন্দর্য্য বেড়েছে। কিন্তুু উন্নত হয়নি লেখার মান ও বিষয়। প্রায় সবগুলো পত্রিকার ঝোঁক হালকা ও চটুল বিষয়ের প্রতি। জাতীয় কাগজগুলোর মূলসুর হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক কাগজগুলো পাঠককে বিন্যাসের ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তির সন্ধান না দিতে পারলেও শেণী,ভিত্তিহীন সমাজের প্রতিটি কর্মকা-ই তুলে ধরার মনোবৃত্তি পোষণ করেন।

আমরা জানি স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতা বিস্তর সমস্যায় আকীর্ণ। কাজেই স্থানীয় প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বুঝতে হলে এসব সমস্যার আলোকে বুঝতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিকরা কতটা লিখছেন বা লিখতে পারছেন তা তলিয়ে দেখতে হবে। না লিখতে পারলে এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো খুঁজে দেখতে হবে। মূল কারণগুলো খুঁজে বের করতে না পারলে একই সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে থাকবে স্থানীয় সাংবাদিকতা,এগুবে না। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে ভাবনার দাবি রাখে। এমন না যে বিষয়গুলো প্রথমবার উল্লিখিত হচ্ছে। বহুজনের বহুবার উচ্চারিত বিষয়গুলো পুনঃচিন্তার খোরাক জোগায়। এর মধ্যে একটি হলো পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা গ্রহণ করতে না পারা। অপরটি হলো স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের চাপ,হামলা মামলা ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে নিজেদের ঘরের সমস্যা অনৈক্য ও দলাদলি। স্থানীয় পর্যায়ে যারা জাতীয় বা স্থানীয় পত্রিকার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই নিয়মিত কোনো সম্মানি পান না। দু‘একটি পত্রিকা সম্মানি প্রদান করলেও তা অপর্যাপ্ত। ফলে সার্বক্ষণিক পেশা হিসাবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করার সুযোগ না থাকায় সাংবাদিকদের অন্যান্য পেশা বা কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই সাংবাদিকতা করতে আসেন। ফলে তাদের পক্ষে পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে কাজ করা কতটা সম্ভব সেটি ভেবে দেখা দরকার। বিশেষ ঘটনা এবং সাদামাটা সংবাদ ছাড়া নিজ খরচায় প্রান্তিক পর্যায়ের খবরাখবর বা গভীর প্রতিবেদন রচনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়না। ফলে এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টিই অর্থহীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় স্বাধীনতা আজ নানা শৃঙ্খলে আবদ্ধ। একটি প্রশ্নবিদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার এমনকি দুষ্ট গণতন্ত্রের অবকাঠামোয় সাংবাদিকতা চর্চার ধারার অবস্থা এমন যে,স্বাধীনতাকে ছাপিয়ে কখনো কখনো শৃঙ্খলাই বড় হয়ে উঠছে। শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য রয়েছে ১৩টি নানান আইনের ব্যারিয়ার। কোনটা ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত,কোনটা পাকিস্তান আমলে আর কোনটা খোদ বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের শাসনামলে-উপরন্তুু আছে আইন বহির্ভূত নানা বিধি-নিষেধ, হুমকি চাপ-সংবাদপত্রগুলোকে বশীভূত বা দমন করার হরেক রকম কলা-কৌশল। শৃঙ্খলিত সাংবাদিকতা নিশ্চিতকরণে প্রচলিত আইনের কাঠামোর কখনো আরোপিত প্রয়োগ আবার বেশির ভাগ অপপ্রয়োগের কথা বাদ দিলেও বলতে হয় অসুস্থ ও দখলদারির রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন মার খাচ্ছে,তেমনি সংবাদপত্রগুলোতে অসৎ ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে সুকৌশলে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা,সর্বোপরি সাংবাদিক সমাজের মধ্যকার অনৈক্য ও বিভাজন স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চার পথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। জন্ম নিচ্ছে ‘দ’সাংবাদিকতার। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হচ্ছে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দ-সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা কেউ দলীয়,আবার কেউ দুষ্ট,দূষিত,দন্ডনীয়,দমনমূলক কিংবা দালালী এরকম যতো নেতিবাচক বিশেষণ যুক্ত করবেন,ঠিক কোনটাই বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আজকের পরিস্থিতিকে হয়তো ধারন করতে পারবেনা। এমতাবস্থায় স্বাধীন সাংবাদিকতার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার প্রশ্ন,জন আস্থার প্রশ্ন সর্বোপরি পেশাগত রীতির প্রশ্নকে ব্যঙ্গ করে জন্ম নেয় এক চির অপরিচিত সাংবাদিকতা। এ-অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার কিছু বিষয়কে আমরা ভেবে দেখতে পারি?
স্থানীয় সাংবাদিকের পরিচয় যেনো শুধুই সাংবাদিক।একজন সাংবাদিক যদি রাজনীতি করতে চান তাহলে পেশাটি ছেড়ে দিয়ে সরাসরি দলে নাম লেখানোই উত্তম। এতে সাংবাদিকতা রক্ষা পায়। জটিলতা কমে।
একজন পেশাদার ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকের টিকে থাকা একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে তার পেশাগত দক্ষতা। কাজেই সব সাংবাদিককে হয়ে উঠতে হবে যোগ্যতম,বুঝতে পারায়,লিখতে পারায় তাকে হতে হবে দক্ষ। এ পেশাগত দক্ষতাই হতে পারে রক্ষাকবচ।
কোনো সাংবাদিক যখন একান্ত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দায়িত্ব পালন করবেন,তখন সেখানে সাংবাদিকের পরিচয়টি মূখ্য করে না তোলা।
এতো গেলো একজন কি করতে পারেন তার কথা। কিন্তুু গোটা পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগের। আর সামাজিক উদ্যোগগুলো হতে পারে-
স্থানীয় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকা। পত্রিকার পরিচয়ে নয়,আমরা সবাই সাংবাদিক এ পরিচয় হতে পারে মূল দর্শন।
পেশাদার ও ভালো সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতৃত্বে আনা। এতে সংগঠন ও ঐক্যের ভিত্তি জোরদার হবে,সংগঠনের মর্যাদাও বাড়বে। জাতীয়ভাবে সুশীল সমাজ,গণমাধ্যম কর্মী ও সরকারের সংলাপের পথটি সবসময় খোলা রাখা। এতো পুরানো আইন পরিবর্তন,নতুন আইন প্রণয়ন এবং গণমাধ্যম বিষয়ক এজেন্ডাগুলোকে জাতীয় ইস্যুতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
শক্তিশালী স্থানীয় পক্ষ ছাড়া মফস্বল সাংবাদিকদের অপর প্রতিপক্ষ হচ্ছে প্রশাসন। স্থানীয় প্রশাসনের বিপক্ষে সংবাদ চলে গেলে আর রক্ষা নেই। যেভাবে হোক তারা সাংবাদিককে বিপাকে ফেলতে চায়। জনগণের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দেখা যায় মফস্বল সাংবাদিকদের অধিকাংশই প্রশাসনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এর বিপরীতে কিছু যে ঘটেনা তা নয়। কোথাও কোথাও প্রশাসনের দুবর্লতার সুযোগে মফস্বল সাংবাদিকদের বদৌলতে জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটা যদিও খুব কম ক্ষেত্রে ঘটে তবুও কোনো ভাবে সমর্থন যোগ্য নয়। ঢাকার বাইরে সাংবাদিকদের অনেক সমস্যা আছে। গামছা পরে,নদী সাতরে সংবাদ সংগ্রহের ঘটনাও আছে অসংখ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকা গবেষণা রিপোর্টে ৬৬ জন ২৭জন সম্পাদক সর্বমোট ৯৩জন সাক্ষাৎকারে ফলাফলে প্রকাশ পায় ২৮টি পত্রিকার বেশিরভাগই মালিক,প্রকাশক,সম্পাদক একই ব্যক্তি। পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি এরা সবাই অন্য পেশার সাথে জড়িত। ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন হয়েছিল মাত্র পাঁচটি পত্রিকার। নতুন ধরনের আবদ্ধ সাংবাদিকতা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। মজার ব্যাপার হলো উল্লেখিত প্রশ্ন নিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের সাংবাদিকতা চর্চার ধারাকে কেউ প্রশ্ন করতে পারেনা। বলতে দ্বিধা নেই,আমরা সাংবাদিকতার ক্রান্তিকালে পৌঁছে গেছি:নিপীড়ন মৃত্যুকে আলিঙ্গন হুমকি আর রক্ত চক্ষুকে ভয় পাওয়া সবকিছু কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। সবখানে এক ধরনের হতাশা,অনৈক্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়ে আছে। উত্তরণের পথ খোঁজার উপায়ও ক্রমশঃ সীমিতহতে বসেছে এবং ক্রমেই নতুন ধরণের সাংবাদিকতার উদ্ভব হচ্ছে। আমরা যারা পুস্তকের সৎ ও বস্তুনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাঠদান করি তারাও হতাশ হচিছ প্রতিনিয়ত।
,দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক হুমকির কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী সমালোচনার। সাংবাদিক নির্যাতনের রেকর্ড ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চোখে অন্যতম ‘নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার দেশ।’ দেশের প্রচলিত রাজনীতির এমন বিভক্তির পথ ধরে সাংবাদিক সমাজের মধ্যে অনৈক্য ও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়-পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়কে এড়িয়ে যায়-স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার পথকে অবরুদ্ধ করে রাখে। আজকের স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বিশ্লেষণ করতে হলে উল্লেখিত কয়েকটি দিক বিবেচনায় আসে স্থানীয় পর্যায়ের অসংখ্য বিষয় আছে যেগুলোর সংবাদমূল্য থাকলেও রিপোটিং হয়না বা সঙ্গত কারণে সাংবাদিকগণ রিপোর্ট করতে পারেন না। এর মধ্যে কিছু বিষয় আছে যেগুলো ইচ্ছে করে ধামাচাপা দেয়া হয়। ফলে স্থানীয় অনেক জনগুরুত্ব সম্পন্ন সংবাদই আলোর মুখ দেখেনা। সেসব নানা কৌশলে ধামাচাপা দেয়া হয়। প্রশাসন বা প্রভাবশালী মহল ভয়ভীতি দেখিয়ে বা কিছু সাংবাদিকের দলীয় আনুগত্য ও অনৈক্যের সুযোগ অবাধ তথ্য প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত কারণে সংবাদ প্রেরণ থেকে বিরত থাকেন অনেক স্থানীয় সাংবাদিক।
অনেককে বলতে শোনা যায় সাংবাদিকরা সবার দুর্নীতির কথা লেখে থাকে,কিন্তু তারা কতটুকু স্বচ্ছতা বজায় রাখে তা নিয়ে কোনো লেখা হয়না। ক্ষেত্রে সৎভাবে সত্য তুলে ধরার কারণে সাংবাদিকরা হামলা,মামলা,হুমকি হয়রানি শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ চিরতরে নিস্তদ্ধ হয়ে গেছেন। গোটা দেশ যখন ঝুঁিকর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতায় দেশের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে তখন পেশাগত পরিচয়ের কারণে সাংবাদিকরা নিরাপদ থাকবে তেমনটি আশা করা বৃথা। বরং এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের সমস্যা দ্বিমুখী।
প্রথমতঃ সাধারণ নাগরিক হিসাবেই তিনি নিরাপত্তাহীন। দ্বিতীয় : অসহিষ্ণু একটি সমাজে সাংবাদিকতা করতে চান,সত্য কথা বলার চেষ্টা করেন,দুনীর্তির যারা জড়িত তাদের নামঠিকানা প্রকাশ করে দিতে চান। কাজেই কিছু খারাপ মানুষের দৃষ্টি তো তার প্রতি থাকবেই। এ খারাপ মানুষেরাই আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী,সবচাইতে ক্ষমতাধর-তারা যা ইচ্ছে করে তাই করতে পারেন এবং বিত্ত-প্রভাব দু‘য়ের মিলনে সবকিছু সামলাতে পারেন। তাদের এককভাবে মোকাবেলা করা নিরীহ সাংবাদিকের কাজ নয়। ঐ ঘটনার সাথে জড়িত সরকারি দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের চাপে অথবা তাদের সাথে এক ধরণের রফা হওয়ায় রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
ফলে দেখা যায় প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হবার আশংকায় এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে স্থানীয় সাংবাদিকরা অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতেও এই প্রভাব বলয়ের বাইরে না। জেলার আইন শৃংঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হলে স্থানীয় পত্রিকার এক সম্পাদককে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে কি রঢ় আচরণ করেছিলেন এবং প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছিলেন তার কাহিনী বলছিলেন এক সম্পাদক। মূলতঃ প্রতিনিয়তই এরকম বিরুদ্ধ প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয় স্থানীয় সাংবাদিকদের। এই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অদৃশ্য মরিচিকা হয়েই থাকবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি তাই খন্ডিত আকারে না দেখে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রশাসনিক,সামাজিক চাপ ও বিধিনিষেধ,সাংবাদিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা,নিজেদের মধ্যে অনৈক্য এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শুধুমাত্র কথাই থেকে যাবে। তাই সাংবাদিকদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আইন প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে। সেই সাথে নিজেদের বিভেদ দূর করে একতাবদ্ধ হলে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। ঐক্য এবং দায়িত্বশীলতাই হতে পারে সাংবাদিকদের রক্ষাকবচ।

লেখক:সাংবাদিক, কলামিস্ট।