বিপ্লব পরবর্তী বিভাজন 

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে—ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব তার জ্বলন্ত উদাহরণ, যখন গণমানুষের ক্ষোভ, দাবী এবং দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এক বিস্ফোরণ ঘটে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাময়িক ঐক্য, জনগণের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের একচোখা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ—সব মিলিয়ে ওই সময়ে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল।
কিন্তু আজ, বিপ্লবের দশমাস  না যেতেই রাজনৈতিক অনৈক্যের কালো ছায়া নেমে এসেছে। যে ঐক্য একদিন জনতার আশা জাগিয়েছিল, আজ তা টালমাটাল। বিভাজন, দলে দলে ছিন্নমূল হওয়া নেতাকর্মী, আদর্শগত অস্পষ্টতা ও নেতৃত্বের সংকট আগামী দিনে যে একটি প্রতি-বিপ্লবের দরজা খুলে দিতে পারে—তা আর অনুধাবনের বিষয় নয়, বরং বাস্তবতা হিসেবে দৃশ্যমান হচ্ছে।
ইতিহাস কী বলে?
বিশ্ব রাজনীতিতে দেখা গেছে, প্রতিটি বিপ্লবের পরই এক প্রতিক্রিয়াশীল প্রবাহ জন্ম নেয়। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) শেষে রবার্সপিয়েরের নেতৃত্বে যে জ্যাকোবিন শাসন গড়ে ওঠে, তা যতটা না জনগণের মুক্তির জন্য ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ক্ষমতা কেন্দ্রিক। রক্তপাত, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, বিভ্রান্তি—সব মিলিয়ে এক সময় নেপোলিয়নের মতো একজন “মুক্তিদাতা স্বৈরাচারী” আবির্ভূত হন। রুশ বিপ্লবের (১৯১৭) পরেও লেনিন-ট্রটস্কি যুগের আদর্শিক সংঘাত স্তালিনের একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়, যা বিপ্লবের আত্মাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দেশ পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল, সেই চেতনার অবসান ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। কারণ? দলীয় দমননীতি, মতপ্রকাশের সংকোচন, ও একই নেতার চারপাশে দালালি ও সুবিধাবাদীদের ভিড়। এ অভিজ্ঞতাও আমাদের বলে দেয়—একটি বিপ্লবের পরে যদি সততা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক ঐক্য এবং নেতৃত্ব না থাকে, তবে বিপ্লব নিজেই নিজের কবরে ঠেলে যায়।
জুলাই বিপ্লব: আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?
২০২৪ সালের সেই ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ছিল—একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে, যেখানে সকল মত ও পথের মানুষের সহাবস্থান থাকবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সেই সময়কার ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম আজ বিভক্তিতে ভুগছে। কিছু নেতা নিজেদের দলকে পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত, কেউ কেউ পারস্পরিক দোষারোপে লিপ্ত, আবার কেউ কেউ রাজনীতির মাঠ ছেড়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ে মগ্ন।
জাতীয় ঐক্যের নামে গঠিত জোটগুলো এখন বিভক্তি ও বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত। জনতার সাথে সরাসরি সংযোগ হারিয়ে তারা আবারও “সেন্টার ফর পাওয়ার” খুঁজছে—জনতার রাস্তায় নয়, বিদেশি দূতাবাসের লবিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা যাচ্ছে একে অপরকে নিচে নামানোর প্রতিযোগিতা, যেন বিপ্লবের আত্মা ছিল কেবলই স্বার্থের লেনদেন।
প্রতি-বিপ্লবের পূর্বাভাস
এ পরিস্থিতিতে যদি আবারো একটি সংগঠিত জনতার স্রোত সৃষ্টি হয়, সেটি আগের মতো নয়, বরং সেই বিপ্লবের “বিরোধিতা” হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হলে, যখন তারা বুঝে যে তাদের নাম ভাঙিয়ে আবারও পুরনো ধারা ফিরে এসেছে, তখনই বিপ্লবের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয়।
প্রতিরোধ-প্রতিবাদ আর প্রতিশোধ এক নয়। কিন্তু আজকের রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সহনশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ও ত্যাগের মানসিকতা ফিরিয়ে না আনে—তাহলে জনতার আস্থা আর থাকবে না নেতৃত্বে। তখন কোনো নতুন শক্তি, কোনো তৃতীয়মুখী আদর্শ, কিংবা চরমপন্থার হাত ধরে গড়ে উঠতে পারে এক ‘প্রতি-বিপ্লব’, যার পরিণতি আবারও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে দেশকে ঠেলে দেবে।
জুলাই বিপ্লব একটি সময়ের দাবি ছিল—সেই সময়ের প্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ সেই দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, জনগণকে ভুলে যায়, তবে ইতিহাসের চাকা আবার ঘুরবে—এবার বিপরীত দিকে। এবং তখন সেটি হবে না আর কোনও ঐতিহাসিক উত্তরণের গল্প, বরং এক প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিঘাতের শুরু।
এ আশঙ্কা এড়িয়ে যেতে হলে এখনই সময়, নেতৃত্বদের উচিত আত্মসমালোচনা, মাটি ও মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া, এবং সবচেয়ে বড় কথা, ঐক্যকে পুনর্গঠনের জন্য ত্যাগের মনোভাব দেখানো। নইলে ইতিহাস শুধু গর্ব নয়, আক্ষেপও বয়ে আনে—যার সাক্ষী হতে পারে আবারো একটি প্রজন্ম।
inside post
আরো পড়ুন