যে মসজিদে ইবাদতে প্রশান্তি মিলে

সাইফুল ইসলাম সুমন।।
কুমিল্লা নগরীর মোগলটুলীতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘শাহ্ সুজা মসজিদ’। চুন-সুরকির শক্ত বন্ধনে নির্মিত এ মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, এটি হয়ে উঠেছে মোগল যুগের শিল্প, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের জীবন্ত দলিল।
চারশ বছরের পুরনো এই মসজিদ সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় সুনির্দিষ্ট কোনো সাল নেই। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এটি ১৬৫৮ খিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজার শাসনামলে নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সেই সময়ের মোগল ফৌজদার কুমিল্লা শহরাঞ্চলের মোগলঘাঁটির মুসলমানদের জন্য নামাজের স্থান হিসেবে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
মসজিদের আদি অবয়ব আজও মূল কাঠামোয় বহাল রয়েছে। আয়তনে ছোট হলেও এর প্রতিটি ইঞ্চি যেন ঐতিহ্য আর গৌরবের গল্প বলে। তিনটি গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজটি দুই পাশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বড়। চার কোণায় রয়েছে চারটি অষ্টকোণাকৃতি মিনার। সামনের দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশদ্বার, যার মধ্যে কেন্দ্রীয়টি বিশেষভাবে বড় ও অলঙ্কৃত। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মেহরাব, যার মাঝেরটি আকৃতিতে অন্যান্যদের চেয়ে প্রশ^স্ত। সামনের প্যানেল ও কার্নিশের ওপরে ব্যাটলম্যান্ট এবং তার ওপরে একটি চমৎকার গম্বুজ স্থাপত্যশৈলীর নিখুঁত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে।
কালের বিবর্তনে মসজিদের মূল কাঠামোয় কিছু পরিবর্তন এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর দুই পাশে ২২ ফুট দৈর্ঘ্যরে দুটি কক্ষ এবং সামনে ২৪ ফুট প্রশ^— বারান্দা সংযোজন করা হয়েছে, যার ফলে আদি রূপ কিছুটা বিকৃত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। উত্তর-পূর্ব কোণে একটি সুউচ্চ মিনারও নির্মিত হয়েছে।
শাহ্ সুজা মসজিদের ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা গর্ব ও আবেগের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আব্দুল আবাদ বলেন, এই মসজিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আল্লাহওয়ালা লোকজন আসেন, ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হন। শুধু নামাজ নয়, এখানকার পরিবেশে রয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। শাহ্ সুজা মসজিদ আমাদের জন্য একটি গর্বের প্রতীক, যা প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সৈয়দ মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, প্রায় চারশ বছর আগে যারা এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, তারা ছিলেন অত্যন্ত গুণী, দক্ষ ও দূরদর্শী চিন্তাবিদ। সময়ের কঠিন পরীক্ষায় টিকে থাকা এই স্থাপনা তাদের সৃজনশীলতার অমর সাক্ষ্য বহন করে। আজও মসজিদটি কালের নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে।”
মসজিদটির ভেতরে প্রবেশ করলেই অনুভব করা যায় শীতল ও প্রশান্ত এক পরিবেশ। মসজিদের কিছু অংশে আধুনিক এসি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা নামাজরত মুসল্লিদের আরাম দেয়।
মুসল্লি মো. ইসহাক বলেন, এ মসজিদে এসে আমি মুগ্ধ। ভেতরের পরিবেশ এত আরামদায়ক যে সব আবহাওয়ায় এখানে নামাজ পড়ে আরাম পাওয়া যায়।
আরেক মুসল্লি মহসিন মিজি বলেন, “সব মসজিদই ইবাদতের স্থান। তবে শাহ্ সুজা মসজিদের কারুকার্য, গম্বুজ ও মিনারের শৈল্পিক সৌন্দর্য হৃদয়ে ভালো লাগা দোল দেয়। এখানে এলে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করি।”
মসজিদের খতিব মুফতি খিজির আহমদ ক্বাসেমী জানান, “প্রতিদিন এখানে বহু মুসল্লি নামাজ পড়তে আসেন। যোহরের জামাত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দুপুর ১টায় অনুষ্ঠিত হয়, সময় এখনো পরিবর্তন করা হয়নি। জুমার দিনে প্রায় দুই হাজারের বেশি মুসল্লি এখানে একত্রিত হন।
এই মসজিদ ঘিরে বহু কাহিনি ও জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, ত্রিপুরা বিজয়ের স্মারক হিসেবে শাহ্ সুজা নিজে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। আবার কারও মতে, ত্রিপুরার মহারাজ গোবিন্দ মানিক্য সুজার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই মসজিদ নির্মাণে অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
ইতিহাসবিদ আহসানুল কবির বলেন, এই মসজিদ মোগল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। সম্ভবত শহরের মোগলঘাঁটি অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য তৎকালীন ফৌজদার মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং এটি শাহ্ সুজার নামে নামাঙ্কিত হয়।”
তিনি আরও জানান, মসজিদে প্রথম খুৎবা প্রদানকারী ছিলেন শহরের কাজী কাজী মনসরুল হক (রহ.)।
ঐতিহাসিক নিদর্শন শুধু প্রাচীন ভবন নয় সেগুলো একটি জাতির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও গৌরবের প্রতীক। শাহ্ সুজা মসজিদও তেমনি একটি নিদর্শন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কুমিল্লা শহরের মাটিতে ঐতিহ্যের বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, এটি ইতিহাসের এক নীরব পাঠশালা।

inside post
আরো পড়ুন