রড কেটে ট্যাক্সি চালিয়ে ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

 

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
উচ্চতা ৫ফুটের মতো। ছোটখাট আকারের মানুষ। ৪০বছর ধরে প্রবাসে কাজ করেন। কখনও রড কেটেছেন। কখনও খাবারের দোকানে কাজ করেছেন। এখন নিউইয়র্কেও রাস্তায় ট্যাক্সি চালান। সারা জীবনের আয়ে আমেরিকায় বাড়ি করতে পারেননি। কুমিল্লা ও ঢাকায় তার কোন বাড়ি নেই। গ্রামের বাড়িতে একটি বাড়ি নির্মাণ শুরু করছেন। পরিবারও আমেরিকা নিতে পারেননি। স্ত্রী-সন্তানদের দেশে রেখে বিদেশে মেসে জীবন পার করেছেন। খান আলুর ভর্তা আর ডাল ভাত।

 

এই সাদাসিদে জীবনযাপন করা মানুষ মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ধান্যদৌল গ্রামে জন্ম তার। সারা জীবনের আয়ে তার গ্রাম ও উপজেলায় গড়ে তুলেছেন ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী ও মোসাম্মাৎ আশেদা খাতুন চৌধুরী দম্পতির ঘরে মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর জন্ম। ১৯৭৪ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী মারা যান। ৬ সন্তানকে নিয়ে মায়ের কষ্টের পথচলা। চাচাদের সহায়তায় দিন চলে তাদের। ১৯৮৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর কাতারে চলে যান। প্রবাসে যাওয়ার উদ্দেশ্য পরিবারের হাল ধরা। ভাই বোন বড় হয়ে যাওয়ার পর মনোযোগ দেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ায়।

(ধান্যদৌল গ্রামে পৈত্রিক বাড়ি)

১৯৩৭ সালে ধান্যদৌল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তার বাবার দাদা সিরাজ খান চৌধুরী। ১৯৫৭ সালে মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর বাবা আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এলাকা থেকে শিক্ষক নিয়ে সেখানে চাকরি দেন। তাদের পথ ধরে ১৯৮৯ সালে ধান্যদৌল গ্রামে বাবার নামে আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৪ সালে আম্মা ও দাদির নামে আশেদা-জোবেদা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। ১৯৯৯ সালে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরে মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর এই উপজেলা সদরে আবদুল মতিন খসরু মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সালে মুমু রোহান কিন্ডার গার্টেন নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ২০১০ সালে ব্রাহ্মণপাড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণে দান করেন ১ বিঘা জমি। এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য নিজ নামে গড়ে তোলা ফাউন্ডেশন থেকে ব্যবস্থা করেছেন শিক্ষাবৃত্তির।

মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আমরা অথৈ সাগরে পড়ে যাই। পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে লেখা পড়া ছেড়ে কাজে যোগ দেই। পরিবারের পূর্ব পুরুষরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। সেই নেশা আমাকেও পেয়ে বসে। প্রতিষ্ঠান গুলোর অধিকাংশ এমপিওভুক্ত। কোন আর্থিক সুবিধা নেই না। এখনও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজের আয় খরচ করছি। এটাতে আমার আনন্দ। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা আরও কীভাবে মানসম্মত করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এছাড়া কারিগরি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এলাকাকে নিরক্ষর মুক্ত করারও পরিকল্পনা করছেন বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, যখন প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় হাত দেই। বিভিন্নজন নানা রকম কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন,বেশি টাকা হয়েছে। টাকা জলে ঢালতে এসেছে। কিছু দিন পরে সব ফেলে পালাতে হবে। তবে নিজের মানসিক দৃঢ়তা আর কিছু নিবেদিত প্রাণ এলাকাবাসীর সহযোগিতা ছিলো।

পরিবারকে সময় দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিয়ের ১৪দিনের মাথায় বিদেশ গেছেন। বড় সন্তান মেয়ে। তার ১১বছর পর্যন্ত তিনবার দেশে আসতে পেরেছেন। সন্তানকে বুকে নিয়ে আদর করার আগে সে বড় হয়ে গেছে। ছেলে ছোট। তার তিন বছর বয়সে প্রথম দেখেন। অপরিচিত দেখে সে তাকে বাসায় ঢুকতে চাইছিলো না। সন্তানদের সাথে সেই দূরত্ব এখনও কমেনি।

সার জীবনের আয় দান করার বিষয়ে তিনি বলেন, সবাই দান করতে পারেন না। এজন্য আল্লাহর রহমত লাগে। আল্লাহ যার পক্ষে থাকেন, প্রকৃতিও তার পক্ষে থাকে। তার সাহায্য থাকায় এসব কাজ করতে সক্ষম হয়েছি। এমন ত্যাগ শুধু আমি নই, বঙ্গবন্ধুও করেছেন, মহাত্মা গান্ধীও করেছেন। কাউকে তো করতেই হয়, নইলে পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে আলোকিত হবে।

আনন্দের স্মৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, যখন আমেরিকার রাস্তায় ট্যাক্সি চালাই। নানা কারণে মন বিষণ্ন হয়। তবে যখন মনে ভেসে আসে দেশে আমার প্রতিষ্ঠানে ছয়-সাত হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। তখন মনটা আনন্দে ভরে উঠে।
এ সব কাজে সহযোগিতার জন্য সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী, তার সহধর্মিণী ফয়জুন নাহার চৌধুরী পিনুর প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু জাফর খান বলেন, মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী একজন আলোকিত মানুষ। তাদের আলোয় সমাজ আলোকিত হচ্ছে। সারা জীবনের আয় শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা মানুষের প্রতি আমাদের অভিবাদন। এরকম মানুষের সংখ্যা বাড়লে সমাজ আরো আলোকিত হবে।