রেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় কার

 

।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী ।।

প্রতিদিনকার মতো স্কুলে যাচ্ছিল নবম শ্রেণির মীম। কুমিল্লা সদর রসুলপুর স্টেশনের কাছে রেল লাইন পেরিয়ে যেতে হয় স্কুলে। বৃহস্পতিবার (১৬ মে) সকাল ৯ টার দিকে ওই পথে ঢাকা- চট্টগ্রাম ডাবল লাইন পাড় হওয়ার সময় ট্রেন আসতে দেখে পাশের রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে মীম। পাশের ট্রেন দেখলেও অন্য লাইনের ট্রেন না দেখায় মূহূর্তেই ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলে ঘটে নির্মম মৃত্যু । রেললাইনের পাশে স্কুল থাকায় এভাবেই লাইনের ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। স্কুল শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের যাতায়ত এপথে করতে হলেও স্টেশনের দক্ষিণ পাশে কাটানিসার মাজারের সামনে অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং ছিল না, তবে হাটা-চলার পথ গড়ে উঠেছিল। ঘটনার পর পরই শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করে। যথারীতি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি হাজির হন। আশ্বাস মিলে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এখানে লেভেল ক্রসিং হবে, পাহারায় বসবে রেলের গেইটম্যান, আর দেয়া হবে গেইট। এমন একটি অতীব প্রয়োজনকে বাস্তবতায় নিয়ে পৌঁছাতে একটি নির্মম মৃত্যুর প্রয়োজন পড়ল। এতোদিন যা কেউ ব্যবস্থা নেয় নি। আমাদের দেশে জীবন দিয়েই জীবন-যাপনের এসব ব্যবস্থাপনাও আদায় করে নিতে হয়। ভাবতেই অবাক, অসহায় লাগে।

ট্রেনের ধাক্কায় বা কাটা পড়ে শুধু ঢাকা রেলওয়ে জেলাতেই ২০২২ সালে মারা যায় ৪৬৭ জন। রেল দুর্ঘটনায় যত মৃত্যু হয়, তার ৮৫ ভাগই রেলক্রসিংয়ে ঘটে। মৃত্যুর অন্য দুই কারণ বৈধ ক্রসিংয়ে পাহারাদার-গেইটম্যান না থাকা, পারাপারে অসর্তকতা বা জনসচেতনতা।

সড়কে মৃত্যু, আইন আছে, আছে শাস্তির বিধানও। রেলওয়েতে এমন মৃত্যুর দায় নেই, তাই আইন ও শাস্তির প্রশ্ন ওঠে না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আইনের আশ্রয় নেয়ারও সুযোগ পায় না । উল্টো দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের অভিযুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। ট্রেন চলাচলে বাধা বা এমন চেষ্টা আইনত দণ্ডনীয়, দু’ বছরের জেল। ট্রেন চলে সরল পথে। নিজস্ব লাইনে। রেলক্রসিংয়ের মৃত্যু বা দুর্ঘটনা তাই বাধা হিসেবে বিবেচিত। এমন দুর্ঘটনার দায় মৃত ব্যক্তির।

রেল আইনে রেলক্রসিংয়ে যে সব দুর্ঘটনা সেগুলো রেলের দুর্ঘটনা নয়। ফলে এমন মৃত্যু বাড়লেও কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। তাই এমন মৃত্যুর হিসাবও রাখে না রেলওয়ে। মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, এক ট্রেনকে অন্য ট্রেনের ধাক্কা, রেলক্রসিংয়ের গাড়িকে ট্রেনের চাপা- এসবকে দুর্ঘটনা বলা হয়েছে ।

অবৈধ-অরক্ষিত রেলক্রসিং কেন। এসব ক্রসিং রেল আইনে বৈধ নয়। তাই ট্রেন চলাচলের সময় যান-বাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নেই। গেইট, পথরোধক-প্রতিবন্ধকতা, লাইট, বিকট শব্দের ঘন্টাতো নেইই, পাহারাদারও নেই। গেইটগুলো চলে পুরনো পদ্ধতিতে। ট্রেন আসা-যাওয়ার খবর দেয়া হয় ল্যান্ড টেলিফোনে, যা আবার নষ্টও থাকে। রেল আইনে লাইন তৈরি হওয়ার পর চলাচল শুরুর ১০ বছরের মধ্যে এর ওপর দিয়ে সড়ক গেলে সুরক্ষার দায়িত্ব রেলের। এরপর সড়ক নির্মিত হলে সেই ক্রসিং সুরক্ষার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণ সংস্থার। আগে অনুমতি নেয়ার বিধান থাকায় জটিলতা এড়াতে কেউ রেলকে রাস্তা নির্মাণের কথা জানায়ও না। অধিকাংশই এলজিইডির সড়ক। পাশাপাশি অন্য চার সংস্থা- পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন এবং সড়ক ও জনপথের (সওজ) সড়ক। যে যার মতো রাস্তা তৈরি করতে হচ্ছে আর এ কারণে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ছেই। শুধু রেলওয়ে নয়, রেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় এই সংস্থাগুলোর একটিও নেয় না।

এক হিসেবে সারাদেশে ২ হাজার ৮৫৬টির মতো লেভেল ক্রসিং, যাকে সাধারণ মানুষ রেলক্রসিং বলে থাকে। ১ হাজার ৩৬১ টির অনুমোদন নেই, অবৈধ – অরক্ষিত। বৈধ ১ হাজার ৯৯৫ টির মধ্যে ৬৩২ টিতে পাহারাদার নেই। কুমিল্লা লাকসাম রেল জংশনের রয়েছে ১৮৪ কিলোমিটার রেলপথ। ঢাকা- লাকসাম- চট্টগ্রাম, লাকসাম- নোয়াখালী ও লাকসাম- চাঁদপুরের বিশাল রেলপথ। কুমিল্লার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আখাউড়া থেকে লাকসামে ১১৭ টি রেলক্রসিং। বৈধ ৩৪ টির কয়েকটিতে নেই গেইট, পাহারাদার।

রেল বলছে, পাহারাদারের চাকরি স্থায়ী নয়। ১৯৮৪ সালের পর স্থায়ী পাহারাদার নিয়োগ হয়নি। প্রকল্পের অধীনে ১৪ হাজার টাকা প্রায় বেতন। প্রকল্প শেষ, চাকুরিও শেষ। ফলে পেশাদার গেইটম্যান নেই। ৮২ ভাগ রেলক্রসিংই অরক্ষিত। অর্থাৎ ট্রেন চলাচলের সময় যানবাহন আটকানোর জন্য কোন পাহারাদার বা প্রতিবন্ধক কিছুই নেই। সুরক্ষিত ১৮ ভাগ রেলক্রসিং চলছে দিনমজুরি ও চুক্তিভিত্তিক লোক দিয়ে। দুই জনে পালা করে রাত-দিনের পাহারা। তার ওপর লোকবল সংকট। তাই পাহারাদার থাকার পরও ১৮ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। যারা আছেন তাদের অধিকাংশেরই প্রশিক্ষণ নেই।

এসব ক্রসিংয়ে পাহারাদারের ভুল বা অবহেলা কিংবা চালকের অসর্তকতা, অবহেলা বা বেপরোয়া মনোভাবের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। সাথে সাধারণের তাড়াহুড়ো, অসর্তকতা, মোবাইলে কথা বা গান শুনতে শুনতে পারাপার এসবতো আছেই। রেলক্রসিংয়ে গাড়িকে ট্রেনের চাপা- এমন দুর্ঘটনার বড়জোর শাস্তি, গেইটম্যানের কর্তব্যে অবহেলার কারণে সাময়িক বরখাস্ত। এমনিতেই লোকবল কম এমন নগণ্য শাস্তিও বেশি দিন রাখলে পাহারা দিবে কে। তাই অল্পদিন পরেই বরখাস্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

বিশেষজ্ঞ ভাষ্য, রেলপথ নিরাপদ করার দু’টি উপায় রয়েছে। পথরোধ (ব্যারিকেড) বসানো, পাহারাদার নিয়োগ। আর রেললাইনের ওপর দিয়ে উড়ালপথ নির্মাণ। বেশ ব্যয় সাপেক্ষ ও বড় প্রকল্প। বাংলাদেশের সব লেভেল ক্রসিং অটোমেশন করতে ৩০০ কোটি টাকা লাগে। অটো সিগনালিংয়ের আওতায় আনা হলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। গত দশ বছরে রেলের পিছনে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এতো টাকা রেলের পিছনে ঢালা হচ্ছে কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষায় কিছু করা হচ্ছে না। যেখানে বিশ্বে রেল অনেক এগিয়ে গেছে সেখানে আমরা এখনও প্রাচীন পদ্ধতিতে চলছি।

রেল ক্রসিং অরক্ষিত হওয়ার চার কারণ নির্ণয় করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। সুরক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। গ্রামীণ সড়ক পাকা হওয়ায় যানবাহনের সংখ্যা ও গতি দুইই বেড়েছে। কি পরিমান সড়ক ও যানবাহন বাড়লো তার হিসাব নেই রেলের কাছে। অনুমতি ছাড়া রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা বেড়েছে। রেল গেইট সুরক্ষায় খরচ করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ট্রেন আসার সামান্য আগে স্বয়ংক্রিয় ঘন্টা বাজার ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

দায় না থাকলেও সব বড় ও আলোচিত দুর্ঘটনার পরই রেল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রায় সব প্রতিবেদনেরই ভাষা, সুপারিশ ও দায়ী করার পদ্ধতি একই। পাহারাদার বা গেইটম্যান উপস্থিত না থাকলেও বড়জোর শাস্তি বরখাস্ত এতটুকুই।

এখন ঢাকা-চট্রগ্রাম রেলপথে নতুন ডাবল লাইন বসানোয় গতি বাড়ানোর চিন্তা চলছে। রেলক্রসিং অরক্ষিত রেখে গতি বাড়ানো যাবে না। পর্যায়ক্রমে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনতে হবে। বুলেট ট্রেনের চিন্তার আগেই।

রেল আইনের দোহাই দিয়ে মানব মৃত্যুকে নিজ- নিরীহ সাধারণের ওপর দায় বর্তাবার পুরনো ব্রিটিশ ব্যবস্থারও যুগোপযোগী সংস্কার প্রয়োজন। কারণ এমন মৃত্যু শুধুই বিচারহীন নিছক দুর্ঘটনা নয়, অবকাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ। যে সংস্থার সড়ক হোক না, কেন রেলক্রসিংয়ে সুরক্ষা না দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। সরকারের দায়িত্ব জনমানুষের চলাচলকে নিরাপদ করা। নতুবা এই অবকাঠামোগত হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্র পরিচালনার একটি দুর্বল দিক হিসেবে চিহ্নিত হবে। যা সরকারকে শুভ কোন বার্তা দিচ্ছে না।

সারা বিশ্বেই রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রেল নিরাপদ হবে না, রেলক্রসিং নিরাপদ করা না গেলে। কিন্তু এতো অবহেলা কেন। এতো নির্লিপ্ততা কেন রাজনীতিক ও আমলাদের। উন্নয়নের কেন্দ্রেতো আনতে হবে মানুষকে, মৃত্যুর মিছিল ঠেকিয়ে, নিরাপত্তা দিয়ে। নাগরিক জীবনকে তুচ্ছ ভাবার মনোভাবের বদল কি হবে না। ব্রিটিশদের রেল আইন কি এখনও চলবে। যেখানে মানুষের মূল্য তুচ্ছ। রেলক্রসিংতো অবহেলার অপর নাম।

পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।