শিক্ষক একজন ছাত্রের দ্বিতীয় জন্মদাতা– মো.মহিউদ্দিন লিটন

ইংরেজিতে একটি বাক্য পড়েছিলাম-  A good teacher is an intellectual father of a student অর্থাৎ একজন ভাল শিক্ষক একজন ছাত্রের দ্বিতীয় জন্মদাতা।  সে ক্ষেত্রে শিক্ষক হলেন দ্বিতীয় পিতা। মানুষ জন্ম গ্রহন করে অক্ষর জ্ঞানহীন ভাবে বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী আঠারো পারা পবিত্র কুরআন শরীফ মাতৃগর্ভে মুখস্থ করে পৃথিবীতে এসেছেন। এ রকম দূর্লভ ঘটনা না ঘটলে মানুষ মাত্র শিক্ষার আলো ছাড়া জন্ম গ্রহণ করে। শিক্ষক শিক্ষার আলো দেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তোলে সভ্য, মনুষ্যত্ব লাভের সুযোগ করে দেন। একজন অশিক্ষিত মানুষ আর সুশিক্ষিত মানুষের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য, একজন শিক্ষার আলোহীন মানুষ বাস্তবিক অর্থে মৃত। শিক্ষকদের সুশিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষ দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে।

 

একটি শিশুকে পৃথিবীতে জন্ম দেওয়া যতটা কঠিন তার চেয়ে হাজার গুন বেশি কঠিন একে সঠিক ভাবে মানুষ করা। আর এ কঠিন কাজটি করেন শিক্ষকরাই। আমি দশম শ্রেণিপর্যন্তকুমিলা- ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই গ্রামে দক্ষিণ শিদলাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিদলাই নাজনীন হাই স্কুলে লেখা পড়া করি। আমার বাবাও একজন শিক্ষক, আমি স্কুলে পড়ালেখার সময় শিক্ষকের সন্তান হিসেবে অনেকর  ভালবাসা পেয়েছি আমার সহপাঠি, শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের নিকট থেকে। এই ভালবাসা থেকেই ভালবেসে ফেলি শিক্ষকতা পেশাকে। আমার দেখা গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষক অর্থের অভাবে কষ্টে জীবন যাপন করেন। তাঁদের জীবনের সংজ্ঞা ভিন্ন। তাঁরা হয়তো অর্থ কষ্টে থাকেন। কিন্তু একজনআর্দশ শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থী ও সমাজের কাছে যে সম্মান পান সেটাকেই তাঁরা তাদের বড় প্রাপ্তি মনে করেন। গর্ব করে সবাই তার সফল ছাত্রের গল্প বলেন, নিজের আর্দশ শিক্ষা কাজে লেগেছে ভেবে তৃপ্তিপান। এখন এ মন-মানসিকতার শিক্ষক হয়তো আছে লোকচক্ষুর আড়ালে। গ্রামে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের যে শ্রদ্ধা ভালবাসা শহরের তুলনায় অনেকাংশে বেশী। পত্রিকার পাতায় দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে একজন শিক্ষককে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ।

 

আবার ফেইসবুকে দেখলাম মাদ্রাসার এক শিক্ষক দিপু নামের একজন ছাত্রকে পড়া না শিখার কারণে বেত দিয়ে আঘাত করে তার পিঠে অনেক বড় বড় দাগপরান। এই ছবিটা ফেইসবুকে দেখে আরেক শিক্ষক লিখেন মাফ করে দাও দিপু।

 

এক শিক্ষক পিটিয়ে তার ছাত্রকে অসুস্থ বানান, আরেক শিক্ষক ঐ শিক্ষার্থীর নিকট ক্ষমা চেয়ে তিনি তাঁর লেখায় বলেন-বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা হবে শিক্ষার্থীদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ও ভালবাসার জায়গা এখানে যদি বেতের আঘাত ও যৌন হয়রানি করা হয়, তখন শিক্ষকদেরকে ছাত্রদের দ্বিতীয় জন্ম দাতা বলা যাবে?  শিক্ষকরা হবেন পিতার মতোই। একজন শিক্ষার্থী পিতামাতার পরে যাকে বেশি শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে, আপন ভাবে, পথ প্রদর্শন মনে করে তিনি হলেন তার শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষক। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট।

 

অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান এর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রসুলাবাদে। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান স্যার একদিন গেছেন তার ছাত্র বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য, তাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু আসন ছেড়ে উঠে বললেন স্যার আপনি! তারপর বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে জোর করে নিজের আসনে বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সাইদুর রহমান স্যার অস্বস্তিবোধ করে বললেন, তুমি বুঝতে পারছোনা আমি তোমার চেয়ারে বসি কি করে?  তুমি হচ্ছো দেশের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাব সুলভ  হাসির দ্যূতি ছড়িয়ে বলেন-আপনি তো প্রেসিডেন্টেরও স্যার। এ কথা বলেই তিনি তার পায়ের কাছে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চান, তিনি কোন ভাবে তাঁর কাজে আসতে পারেন কিনা-ঐ দিন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বঙ্গবন্ধুর নিকট কোন কিছুই বলতে পারেননি চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারে। পরে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান উনার গ্রামে একটি হাসপাতাল, স্কুল, সোনালী ব্যাংকের শাখা, ফ্যামিলি প্লানিং, অফিস, কৃষি অফিস এ প্রকল্প গুলো রাসুলাবাদে স্থাপন করেন। তাঁর স্থাপিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের সাধারণ মানুষের অনেক উপকারে আসে ভেবে তিনি সুখ অনুভব করতেন।

 

অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান এর এক সময়কার ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে কোন মতামত তোয়াক্কা না করে রসুলাবাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করে দেন। কাজটি করার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষককে বলেছিল

‘স্যার আপনি মারা গেলে এসব প্রতিষ্ঠান দেখবে কে? তাই জাতীয়করণ করে দিলাম।’

 

এ হলো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের কিছু ঋণ পরিশোধের নমুনা এই অজানা ঘটনা লিখেছেন সু-সাহিত্যক ও সৃজনশীল লেখক আবুল ফজল এর লেখা বই থেকে শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম।

 

লেখক: অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মডেল কলেজ