শিদলাইতে যেভাবে শান্তির সুবাতাস

৮৮ বছরের সংঘাতে ৪০ জন নিহত
টিনের চালের পানি পড়া নিয়ে ৩বছর সংঘর্ষ

অফিস রিপোর্টার।।
শিদলাই। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার একটি প্রান্তিক গ্রাম। গ্রামটিতে প্রায় ৮০০০ লোকের বাস। দুই পক্ষের ৮৮ বছরের সংঘাতে উভয় দলের ৪০ জন মানুষ প্রাণ হারান। সর্বশেষ এক বাড়ির টিনের চালের পানি অন্য বাড়িতে গড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ চলে ৩ বছর। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া ঘটনায় ভাঙচুর হয় ৫৫টি বাড়িঘর, চলে লুণ্ঠন, পাল্টাপাল্টি মামলা হয় ১৫টি, বের হয় দুই শতাধিক ওয়ারেন্ট। সেই জনপদে আজ শান্তির সুবাতাস। গত প্রায় দুই বছর সেখানে কোনো সংঘাত নেই।


স্থানীয় ও উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়,২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। ব্রাহ্মণপাড়ায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। তাঁর ইউএনও জীবনের প্রথম আইনশৃঙ্খলা সভার মিটিং-এ উপজেলার শিদলাই গ্রামের বড় দল ও ছোট দলের সংঘর্ষের ভয়াবহতার বিষয়ে অবগত হন। উপস্থিতরা জানান, শিদলাই শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হলেও দলগত দ্বন্দ্ব গ্রামের মানুষকে অশান্ত করে তোলে। এ গ্রামে বড় দল ও ছোট দল নামে দুটি পক্ষ বংশপরম্পরায় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে প্রাণহানি, পাল্টাপাল্টি মামলা, হয়রানি ও বসতঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে ইউনও সোহেল রানাকে। তিনি এ নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে শিদলাই শান্তি পরিষদ নামের একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান উপদেষ্টা করেন স্থানীয় সাংসদ আবুল হাসেম খানকে, উপদেষ্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ জাহের ও কমিটির সদস্য করা হয় উপজেলার আট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে, নিজে দায়িত্ব পালন করেন সভাপতি ও সমন্বয়ক হিসেবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) করা হয় সদস্য সচিব। কমিটির সদস্যরা দুই মাস ধরে শিদলাই গ্রামের বড় দল ও ছোট দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। সেবছর ৪ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন হয়। বিরোধ নিষ্পত্তিতে ৯টি শর্ত আরোপ করেন। ০১. চুক্তির দিন থেকে গ্রামে আর কোনো দলপ্রথা থাকবে না। ২. দ্রুততম সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষের উত্তেজনা ও দূরত্ব কমিয়ে অতীতের সকল মামলা প্রত্যাহারে পদক্ষেপ নিতে হবে। ৩. ২০১৬ সালে সৃষ্ট সহিংসতায় ছোট দলের যে ক্ষতি হয়েছে চুক্তি মোতাবেক তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ৪. ৮৮ বছরে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনার একটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণাধর্মী রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে যা পরবর্তীতে কখনও প্রয়োজন হলে প্রমাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। ৫.  উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন  শিদলাই শান্তি পরিষদ নামের একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির অধীন চুক্তির যাবতীয় কার্যাবলী নিয়ন্ত্রিত হবে। ৬. শান্তিচুক্তিকালীন একজন পুলিশের উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে শান্তির পাহারাদার নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন করা হবে। ৭. নির্দিষ্ট দিনে উভয় পক্ষ সব ধরনের অস্ত্র জমা দিবেন। ৮. ভবিষ্যতে যাতে দলাদলি আর না হয় এবং তাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দূরীকরণে দেশবরেণ্য সাইকোলজিস্টদের নিয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।  ৯. উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমাতে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে একে অপরকে দাওয়াত দিবেন।
চুক্তি সম্পাদনের পর গত ১ বছর ৯ মাস যাবত চুক্তি বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যান উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
এই শান্তিচুক্তির ফলে প্রায় ৩০০ জন ফেরারি মানুষের ঘরে ফিরে আসেন, শুরু করেন স্বাভাবিক জীবনযাপন। দুই পক্ষের মাঝে চলমান ১৩টি মামলার মধ্যে দুই হত্যা মামলা (আপোষযোগ্য নয়) বাদে সবগুলো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও পুনর্বাসনে দেড় কোটি টাকা আদায়ের কথা ছিলো চুক্তিকে। যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থদের মোট ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই টাকা উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি পুনবার্সন কমিটির মাধ্যমে বন্টন করা হয়। শান্তিচুক্তির পর দুই দলের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র টেঁটা, বল্লম ও লাঠিসহ বিপুল পরিমাণ দাঙ্গায় ব্যবহৃত দেশি অস্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে শিদলাই আমির হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজের মাঠে জমা নেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দলাদলি বন্ধে আনুষ্ঠানিক শপথ পাঠ করান সংসদ সদস্য আবুল হাসেম খানা।

এলাকায় শান্তি যাতে কখনো বিঘিœত হতে না পারে সেজন্য দুই পক্ষ থেকে ১০ জন করে মোট ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক পুলিশের একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম দেওয়া হয় শান্তির পাহারাদার।  এই শান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে গ্রামেগঞ্জে বেড়ে ওঠা এসব মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন হয়। এই উদ্দেশ্যে শিদলাই আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজে ২০২২সালের ২১ ও ২২ জানুয়ারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর ও প্রভাষক আয়েশা সিদ্দিকা দলপ্রথায় যুক্ত মোট ১০৬ জনকে নিয়ে দুই দিনে ৮ ঘন্টার সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট সেশন পরিচালনা করেন।
শিদলাই গ্রামের দুই দলের এক দল ছোট দলের নেতা সোহেল রানা বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসা দলাদলি, সংঘাত ইউএনও স্যারের পদক্ষেপে বন্ধ হয়েছে। আগে আমাদের ঘরবাড়ি ছিল না। বাচ্চারা পড়াশোনা করতে পারত না। বর্তমানে আমরা সুখে-শান্তিতে বাস করছি।
ব্রাহ্মণপাড়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহা জানান বলেন, ইউএনও সোহেল রানার নেতৃত্বে শান্তিচুক্তির যে পদক্ষেপ সেটি ব্রাহ্মণপাড়ার ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। আমরা থানা পুলিশ এক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করি। শিদলাইবাসী এখন শান্তিতে বাড়িতে ঘুমাতে পারে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবু জাহের বলেন, শিদলাই শান্তিচুক্তি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। অতীতে যেসকল আপোষ মিমাংসা হয়েছে তাতে স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি, কিন্তু শিদলাই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন সচেষ্ট হলে যেকোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত সমূলে উৎপাটন সম্ভব।