সদর হাসপাতাল যেন ওয়ার্ড মাস্টার নজরুলের সাম্রাজ্য!

 

দ্বিমত করলে চলতো চিকিৎসক,কর্মকর্তাকে মারধর
আবদুল্লাহ আল মারুফ ।।
সবাই বলেন, তিনি সদর হাসপাতালের ‘লর্ড’। যার কথায় উঠে বসে সদর হাসপাতালের চিকিৎসক,কর্মকর্তা. নার্স ও আয়া। অথচ কোনমতে প্রাথমিকে গ-ি পেরিয়েছেন তিনি। যার কথা বলছিলাম তিনি কুমিল্লা জেনারেল (সদর) হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল ইসলাম। ক্ষমতার অপব্যবহার করা ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে লাপাত্তা হয়ে গেছেন। হাসপাতালে নেই ৬ আগস্ট থেকে আজ অবদি।
ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল কুমিল্লার সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও কুমিল্লা মহানগর শ্রমিকলীগের যুগ্ম আহবায়ক। তিনি স্থানীয় ধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। বাবা ছিলেন এলাকার পরিচিত গরু ব্যবসায়ী। তার ভাই জগন্নাথপুর ইউনিয়ন সদস্য ও এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত তাজুল ইসলাম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একসময় সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কর্মী ছিলেন নজরুল। ১৯৯৬ সালে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের আশির্বাদে অস্থায়ীভাবে ওয়ার্ড বয় হিসেবে চাকরি পান। বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। ২০০৭ সালে একই এমপির আশির্বাদে স্থায়ীভাবে ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে যোগদান করেন। এরপরেই শুরু হয় নজরুলের জীবনের নতুন অধ্যায়। একরকম অপ্রতিরোধ্য নজরুল নিজেকে সদর হাসপাতালের কর্তা ভাবতে থাকেন। আবাসিক সার্জন যায়-আসে কিন্তু তিনি লর্ডই থেকে যান। চিকিৎসকদের কক্ষ ভাঙাচোরা হলেও নজরুলের কক্ষটি আলিশান। যেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এসে বসতে ও শুতে পারেন। ধীরে ধীরে নজরুল তার সিন্ডিকেট বড় করতে থাকেন। একই স্থানে সরকারি চাকরি দেন স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে। এরপর এমপি বাহারের ছত্রছায়ায় থেকে চাকরি দেন নিজের ভাগিনা শাহাবুদ্দিনকে। একজন অস্থায়ী ওয়ার্ড বয় হলেও শাহাবুদ্দিন ছিলেন সদর হাসপাতালে মামা নজরুলের মতই প্রভাবশালী। তার অমতে গেলেই চলতো মারধর। আর অভিযোগ পৌঁছাতো মামা নজরুলের কাছে। যা অভিযোগ হিসেবেই থেকে যেত বিচার আর পেতনা কেউ।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে হাসপাতালের কর্মরত কয়েকজন জানান, মাস্টার রুলের যত লোক নিয়োগ দেয়া হতো সবই নজরুলের। এর বাইরে একটা লোকও নিয়োগ দেয়া হতোনা। এরমধ্যেই বেশিরভাগ লোক নেশাগ্রস্থ ছিল। তারা টাকার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালের দালালি করতো। তারা রোগী সদর হাসপাতালের সামনের প্রাইভেট হাসপাতাল গুলোতে পাঠাতো। সেখান থেকে টাকা আদায় করতো।
জাল সনদ তৈরি করতেন মামা-ভাগিনা। নজরুলের ছত্রছায়ায় ভাগিনা শাহাবুদ্দিনের মাধ্যমে বানানো হতো জাল সার্টিফিকেট। সেগুলো বিক্রি করতেন হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও মামলার জন্য প্রমাণপত্র বা সার্টিফিকেট বিক্রির চক্রেও ছিলেন মামা ভাগিনার আধিপত্য।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অনেকবারই আমরা এসব ভুয়া সনদের প্রমাণ পেয়েছি। কয়েকদিন পর পর থানা ও আদালত থেকে আমাদের কাছে ভুয়া সনদ কিনা যাচাই করতে নোটিশ আসতো। দেখতাম প্রায় সব গুলোই জাল।
হাসপাতালের এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি আমাদের সাথে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করতেন। উনার লোকেদের সন্তুষ্ট করতে বাইরের মানুষের সামনে আমাদের কোন কারণ ছাড়াই ধমকাতেন। অনেকের চাকরি জীবনের অভিশাপ ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল।
ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এক চিকিৎসক বলেন, চিকিৎসকরা তার কথা শুনতে হতো। কোন চিকিৎসক বা নার্স কথার বাইরে গেলে তাকে সামনাসামনি গালিগালাজ করতো। অনেক সময় গায়ে হাত তোলার নজিরও আছে। কয়েকবছর আগে সাবেক আবাসিক সার্জন জহিরুল হকের সাথে অশোভন আচরণ করেন। যা হাসপাতালের সবাই দেখেছেন। আমরা চাইলেই কোন রোগীকে ভর্তি বা রিলিজ দিতে পারতাম না। সবই তার মর্জির উপর নির্ভর করতো। অনেক সময় মুর্মূর্ষু রোগীকেও ফেরত দিয়েছে শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যদি জানতো বিএনপি বা জামায়াতের লোক তাহলে ফিরিয়ে দিত। ধর্ষণ আর মারামারি ঘটনায় কেউ চিকিৎসা নিতে আসলে তাদের টাকা ছাড়া কোনভাবেই যেতে দিতেন না তিনি। এগুলো জেনেও আমাদের কিছু করার ছিল না। কারণ তিনি স্থানীয় এমপির ছায়ায় থাকতো।
এবিষয়ে জানতে ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল ইসলামকে একাধিকবার কল ও পরে মেসেজ দিলেও তিনি কোন প্রতিউত্তর না দেয়ায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।