সপ্তম শতকের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি পন্ডিত শীলভদ্র

 

পন্ডিত শীলভদ্র। প্রায় দেড় হাজার বছর জন্ম গ্রহণ করেন কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রামে। তিনি সপ্তম শতকের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি পন্ডিত। শীলভদ্র ছিলেন ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। সে সময়ে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিত হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হতো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে তিনি ২০ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করেন। তার কৃতিত্ব নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার দাবি বিশিষ্টজনদের। এনিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

 

লেখক সফিকুল ইসলাম ও কুমিল্লা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের সূত্রমতে, কৈলান গ্রামের একটি ব্রাহ্মণ রাজ পরিবারে শীলভদ্র ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মৃত্যুবরণ ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে। ঐতিহাসিক শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁকে ‘সমগ্র বাঙালি জাতির আদি গৌরবস্তম্ভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও একটি কথা আমাদের মনে রাখবার যোগ্য। নালন্দায় হিউয়েন সাঙ-এর যিনি গুরু ছিলেন তিনি ছিলেন বাঙালী; তাঁর নাম শীলভদ্র। তিনি বাংলাদেশের কোনো এক স্থানের রাজা ছিলেন, রাজ্য ত্যাগ করে তিনি বেরিয়ে আসেন। এই সঙ্গে যাঁরা শিক্ষাদান করতেন তাঁদের সকলের মধ্যে একলা কেবল ইনিই সমগ্র শাস্ত্র সমস্ত সূত্র ব্যাখ্যা করতে পারতেন।’

শীলভদ্র সম্পর্কে জানা যায়, বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ -এর বই থেকে। হিউয়েন সাঙ প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শীলভদ্রের ছাত্র ছিলেন। কুমিল্লা সম্পর্কে হিউয়েন সাঙের বর্ণনা এরকম : এখানে নিয়মিত চাষাবাদ হয়। প্রচুর শস্য আর ফলমূল সর্বত্রই জন্মায়। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ আর লোকদের স্বভাব হচ্ছে ভদ্র। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী, লম্বায় কম আর এদের গায়ের রং কালো। এরা প্রবল বিদ্যানুরাগী আর বিদ্যালাভ করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করে। সত্য আর মিথ্যা এই দুই সিদ্ধান্তেরই লোক এখানে থাকে।’ কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি অঞ্চলে ২টি বড় বিহারসহ ছোট-বড় ৩৫টি বিহার দেখেছেন বলেও হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেন। এ স্থানকে তিনি ‘দি সিটি অব দ্যা ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় নগরী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শীলভদ্র শৈশবেই জ্ঞান অন্বেষণে গভীর অনুরাগী ছিলেন। ২০ বৎসর বয়স পর্যন্ত সমতট রাজ্যের রাজধানী বা প্রধান কেন্দ্র অর্থাৎ লালমাই-ময়নামতিতে অবস্থান করেন; প্রারম্ভ শিক্ষা সেখানেই। তরুণ শীলভদ্র রাজকীয় সম্মান ও ঐশ্বর্যত্যাগ করে অধিকতর জ্ঞান অন্বেষণের জন্য ভারতবর্ষের বহু শিক্ষাকেন্দ্র পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধধর্মসহ সার্বজনীন শিক্ষায় তিনি সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি ভারতের নালন্দায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে শীলভদ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য পদ লাভ করেন। তখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা ১০ হাজার। বিভাগের সংখ্যা ১০০। ১৫০০ শিক্ষক, ১৫০০ স্টাফ। অধ্যাপকের মধ্যে একমাত্র শীলভদ্র একাই ১০০ বিভাগের প্রতিটিতেই গভীর জ্ঞান রাখতেন। শীলভদ্রের প্রকৃত নাম অদ্যাবধি জানা যায়নি। নালন্দায় শীলভদ্রের সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বুদ্ধভদ্র থাকতেন। তিব্বতীয় ভাষায় শীলভদ্রের রচিত বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের উপর একমাত্র গ্রন্থ ‘আর্য বুদ্ধ ভূমি ব্যাখান’।

কুমিল্লা নগরী থেকে চান্দিনা সদর ২০কিলোমিটার। সেখান থেকে কৈলাইন ২৫ কিলোমিটার। ছায়া ঢাকা গ্রাম কৈলাইন। সেখানে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস। গ্রামের লোকজন শীলভদ্র সম্পর্কে তেমন জানেন না। লেখাপড়া জানা প্রবীণ লোকজন কিছু জানেন। এনিয়ে কেউ কখনও খোঁজ খবরও নেয়নি। তবে কুমিল্লার সাবেক জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মালেক শীলভদ্রের জ¥স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। স্থানীয়দের মতে, সিংহ বাড়িতে শীলভদ্রের জন্ম। এখানে একটি মঠ রয়েছে। সেটি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। তবে সেটি তার সময়কার নয়। তার পরিবারের নির্মিত তিনশ’ বছর আগের বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়ির একটু দূরে রত্ন সাগর দিঘি। সেটি তার পরিবারের বলে দাবি করা হয়। তাদের দাবি শীলভদ্রের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে এখানে তার নামে একটি পাঠাগার বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।

কৈলাইন গ্রামের বাসিন্দা মিহির কান্তি নাগ বলেন, এই গ্রামের সন্তান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন বলে জানি। তার পৈত্রিক ভিটা কোনটি তা নিশ্চিত নই। তবে এই গ্রামের সিংহ বাড়িতে তার জন্ম বলে ধারণা করছি। এই গ্রামের রত্ন সাগর নামের একটি দিঘি রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে শীল ভদ্রের মায়ের নাম রত্নবতীর নামে এই দিঘি। তার স্মৃতি ধরে রাখতে এই গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করছি।
পন্ডিত শীলভদ্র ও তার সময়কার ভারতবর্ষের দিনকাল নিয়ে ‘মহাস্থবির শীলভদ্র’ নামে বই লিখেছেন ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী। তিনি বলেন,ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু জানা যায়,তার আসল নাম দান্তে ভদ্র। তার বাবা মায়ের নাম জানা যায়নি। তিনি রাজ পরিবারের সন্তান ছিলেন। জ্ঞানের অন্বেষায় পথে নেমে আসেন।

গবেষক অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক বলেন,শীলভদ্র বাঙালির অহংকারের নাম। তার সময়ে শীলভদ্রের মতো পন্ডিত লোকের নাম জানা যায়নি। তার র্কীতি নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আরো ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, পন্ডিত শীলভদ্র বাঙালির অহংকার। তার জন্মস্থান পরিদর্শন করবো। মহান ব্যক্তির স্মৃতি ধরে রাখতে তার জন্মস্থানকে ঘিরে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে।

 

সপ্তম শতকের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি পন্ডিত শীলভদ্র। কুমিল্লার এই কৃতি সন্তানের কৃতিত্ব নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আমরা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।