স’মিল শ্রমিক থেকে কোটিপতি!

আবদুর রহমান।।

কুমিল্লা নগরীর চকবাজার-গর্জনখোলা এলাকায় বেশিরভাগ মানুষের মনেই রাজ্জাক গ্রুপ আতঙ্ক। যেন রাজ্জাকের গর্জন আর ভয়ে তটস্থ গর্জনখোলার মানুষ। গত ১৩ মার্চ দুপুরে নগরীর চকবাজার গর্জনখোলা বিদ্যুৎ অফিস গলিতে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মহড়া চলাকালে আবদুর রাজ্জাককে একটি বিদেশি পিস্তল হাতে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এছাড়া তার গ্রুপের আরও অন্তত ৫০ জনের হাতে বিভিন্ন অস্ত্র দেখা গেছে।


এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনার দিন রাতেই রাজ্জাকের বডিগার্ড হিসেবে পরিচিত নগরীর মুরাদপুর মৌলভীপাড়া এলাকার ফরিদ উদ্দিনের ছেলে শহিদুর রহমান সজিবকে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আবদুর রাজ্জাক চকবাজার গর্জনখোলা পশ্চিম পাড়া এলাকার মৃত মালু মিয়ার ছেলে। গত ১৭ মার্চ রাতে র‌্যাবের সদস্যরা নারায়নগঞ্জে অভিযান চালিয়ে রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যে বাড়ির পাশ থেকে ম্যাগজিনসহ একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করে র‌্যাব। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
সরেজমিনে চকবাজার গর্জনখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাজ্জাক কারাগারে থাকলেও এলাকায় তাঁর প্রভাবে কোন ভাটা পড়েনি। আবদুর রাজ্জাক বর্তমানে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। নিজেই এলাকায় গড়ে তুলেছেন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ। এলাকার যুব সমাজের কেউ রাজ্জাকের গ্রুপের বাইরে গেলেই তাঁর উপর নেমে আসে নির্যাতন আর হয়রানি।
গর্জনখোলা এলাকার যুবক মনির হোসেন বলেন, রাজ্জাকের গ্রুপে যোগ না দেওয়ায় প্রায় এক মাস আগে আমিসহ চারজনকে আইনশৃংখলা বাহিনীর লোক দিয়ে আটক করান তিনি। পরে আবার তিনি নিজেই ছাড়িয়ে আনেন এবং আমাদেরকে বলেন- তাঁর গ্রুপে যোগ দিতে। তাঁর কথা না শুনলে মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠাবেন বলে হুমকি দিয়েছেন ।
কুমিল্লা নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের গজর্নখোলা এলাকার বাসিন্দা মো.কামাল মিয়া প্রায় দশ বছর আগে ট্রেনে কাটা পড়ে দু’টি পা হারিয়েছেন। সংসার চালাতে অবশেষে গজর্নখোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিপরীতে নিজ বাড়ির সামনে একটি চায়ের দোকান শুরু করেন তিনি। গত ১৩ মার্চ হঠাৎ করেই কামালের দোকানে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ছেনি, রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো দোকান।

পঙ্গু কামাল মিয়া বলেন, যুবদল নেতা আবদুর রাজ্জাকের গ্রুপের লোকেরা তাঁর দোকানে অতর্কিত সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। আমার সঙ্গে রাজ্জাকের কোন বিরোধ নেই, তার গ্রুপের বাইরের অন্য ছেলেরা কেন আমার দোকোনে আসে, এই অপরাধে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি তাঁর। হামলাকারীদের মধ্যে ছেনি ও রামদা হাতে ছিলেন রাজ্জাকের ছেলে সাজিদ, মারুফ, ভাগিনা হৃদয় ও রিয়াজ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজ্জাকের পাঁচ বোন থাকলেও তাঁর কোন ভাই নেই। তাঁর বাবা প্রয়াত মালু মিয়া ছিলেন নিম্নআয়ের মানুষ। ১৯৯০ সালের দিকে রাজ্জাক সমিলের (করাতকল) শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের মাছের আড়তে। স্কুলের বারান্দায় পা না রাখা রাজ্জাক ২০০৩ সালের দিকে যুবদল কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০১০ সালের পর থেকেই পরিবর্তন হতে শুরু করে রাজ্জাকের ভাগ্যের চাকা। এরই মধ্যে নগরীতে চারতলা বাড়ি, বাড়ির পাশে জায়গা, কয়েকটি ক্যাভার্ডভ্যানসহ নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে তাঁর।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলেন, আবদুর রাজ্জাককে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার এবং পিস্তল হাতে অস্ত্রের মহড়া দেওয়া তাঁর ভিডিওটি আমাদের নজরে এসেছে। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গর্জনখোলা এলাকার বাসিন্দা শাকিল মিয়া বলেন, এলাকায় তুচ্ছ কোন ঘটনা ঘটলেও অস্ত্র হাতে নেমে পড়ে রাজ্জাক গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। রাজ্জাকের বিপুল পরিমাণ অর্থের মূল উৎস হচ্ছে মাদকের কারবার। চকবাজার বাস স্ট্যান্ডের জুয়ার বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
গর্জনখোলা পূর্ব পাড়া বিদ্যুৎ অফিস গলি এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ অফিস গলি দিয়ে কোন ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি এসব ডুকলেই ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলে রাজ্জাকের বিশ^স্ত লোক রাশেদ। অস্ত্রের মহড়া দিয়ে রাজ্জাক গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাশেদও এলাকা থেকে পলাতক রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও সকলকে ম্যানেজ করে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজের কব্জায় নিয়েছেন রাজ্জাক। এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি করলেও চাঁদা চায় তাঁর লোকেরা। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি তাদের নিত্য কাজের অংশ।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী আলো আক্তার বলেন, আমার স্বামী ষড়যন্ত্রের শিকার। অস্ত্রের মহড়ার যেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেখানে আমার স্বামী গিয়েছিলো পরিস্থিতি শান্ত করতে। তাঁর হাতে যেই বিদেশি পিস্তল দেখা গেছে, সেটি আমার স্বামীর নয়, সজিবের। আমার স্বামী অনেক পরিশ্রম করে আজকের এই অবস্থানে এসেছে। তিনি এখন ঠিকাদারী করেন। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা কোতয়ালি মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কমল কৃষ্ণ ধর বলেন, এলাকায় কোন অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে মানুষকে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে হবে। আমরা যখনই অভিযোগ পেয়েছি, তখনই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ভুক্তভোগীরা যদি রাজ্জাকে এসব বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে আসে, তাহলে আমরা অবশ্যই তদন্তের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেব।